Cvoice24.com

একেক প্রকল্পে জনসংখ্যার একেক হিসাব
বরাদ্দ বাগাতে চসিকের ‘চালাকি’

শারমিন রিমা, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১৭:২২, ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪
বরাদ্দ বাগাতে চসিকের ‘চালাকি’

ছবিঃ সিভয়েস২৪

চট্টগ্রাম মহানগরে কত লোক বসবাস করেন? এই প্রশ্নের উত্তর জানতে গিয়ে আপনাকে বিভ্রান্তিতে পড়তে হবে! সরকারি হিসাব অর্থাৎ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ জরিপে জনসংখ্যা ৩৪ লাখের বেশি নয়। তবে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) শহরের জনসংখ্যা কখনো বলে ৬০ লাখ, কখনো ৭০ লাখ কখনো বা কোটির ঘরে নিয়ে যায়।

জনসংখ্যার এই গরমিল কেন— এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে সিভয়েস২৪ চসিকের একের পর এক প্রকল্পের নথি ঘেঁটেছে, সাবেক ও বর্তমান মিলিয়ে দুই ডজন প্রকৌশলী এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে ‘ভুতুড়ে’ এই জনসংখ্যার রহস্য-ভেদ করার চেষ্টা করেছে। চসিকের কর্মকর্তারা এটিকে ‘সামান্য ভুল’ বলে দাবি করলেও জনসংখ্যা বেশি দেখানোর পেছনে খুঁজে পাওয়া গেছে প্রকল্পে বরাদ্দ বাগিয়ে আত্মসাৎ করার এক সুচতুর কৌশল!      

২০২২ সালের ১৫ জুন জনশুমারি ও গৃহগণনার কার্যক্রম উদ্বোধনের সময় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছিলেন, উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন, মূল্যায়নে জনশুমারি ও গৃহগনণার তথ্য উপাত্ত অপরিসীম ভূমিকা পালন করবে। সেই বছরের পরের মাসেই বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) “জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২” প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে। সেখানে প্রাথমিক প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যা দেখানো হয় ৩২ লাখ ২৭ হাজার ২৪৬ জন আর চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সর্বোচ্চ ৩৪ লাখ। তবে জনসংখ্যার এই হিসাব মানে না খোদ চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনই। তাইতো তাদের অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে জনসংখ্যা দেখানো আছে সর্বশেষ জনশুমারির দ্বিগুনেরও বেশি, ৭৫ লাখ। ওয়েবসাইটটি হালনাগাদ করা হয়েছে ২০২১ সালের ২৪ জুলাই; তার মানে সর্বশেষ জনশুমারির এক বছর আগের হিসাব এটি। যদিও ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী চসিকের জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৬ লাখ।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেন, 'চট্টগ্রাম সিটির জনসংখ্যা ৩৪ লাখ? আমি মনে করি আমাদের চট্টগ্রামের জনসংখ্যা প্রায় ৭০ লাখ। আমার এটা যদি ভুল হয়, তাহলে ওদেরকে (বিবিএস) প্রমাণ করতে বলেন।’

ভুলটা কোথায় সেটি খুঁজতে গিয়ে চসিকের জনসংখ্যার হিসাবের ভিত্তি কী— তা জানার চেষ্টা করেও সিটি করপোরেশনের কোনো দপ্তর, কোনো কর্মকর্তা সদুত্তর দিতে পারেননি। ৭০ লাখ জনসংখ্যার স্বপক্ষেও কোনো ধরনের তথ্য-প্রমাণ দেখাতে পারেনি, আমরাও খুঁজে পাইনি। জনসংখ্যার সত্যতা যাচাইয়ে সিটি করপোরেশন এলাকার কোন ওয়ার্ডে কত লোক বাস করে সেই তথ্য জানতে চেয়ে তথ্য অধিকার আইনে আবেদনের পর ‘নিজেদের কোনো পরিসংখ্যান নেই’ জানিয়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জনশুমারির তথ্য সরবরাহ করে চসিক।

শুধু তাই নয়; নির্দিষ্ট একটি জনসংখ্যার হিসাবও দিতে পারেনি চসিক। নিজেদের ওয়েবসাইটে ৭০ লাখ জনসংখ্যার শহর বললেও প্রকল্প পাশ করাতে গিয়ে চসিক কখনো মানুষের সংখ্যা বেশি দেখায়, কখনো বা কম! অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একেক প্রকল্পে একেক ধরনের জনসংখ্যার হিসাব তুলে ধরছে সংস্থাটি। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয়টি প্রকল্পের নথিপত্র ঘেঁটে চসিকের জনসংখ্যা নিয়ে গোঁজামিল খুঁজে পাওয়া গেছে। 

চট্টগ্রাম জেলা পরিসংখ্যান অফিসের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ওয়াহিদুর রহমান বলেন, ’প্রথমত আমাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব ঢাকার মতো না। পাহাড়-সাগর-নদী বেষ্টিত ৬০ বর্গমাইলের শহরে ৭০ লাখের বেশি মানুষ থাকে কী করে? তারা (চসিক) কোন হিসাবে ৭০ লাখ বলছে তা আমাদের জানা নাই। বছর বছর আমরা বিভিন্ন ম্যাথডে (পদ্ধতিতে) জরিপ কাজ চালাই বা চলমান আছে। জনসংখ্যা কোনোভাবেই ৩৪ লাখের বেশি হবে না।’

গত পাঁচ বছরে চসিকের বাজেট বইতে যত জনসংখ্যার তথ্য দেখানো হয়।

জনসংখ্যার সঠিক চিত্র খুঁজে পেতে, ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে চট্টগ্রাম শহরে করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ গ্রহণকারী মানুষের হিসাব চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে সংগ্রহ করা হয়। সেখানে দেখা যায়, ৫ বছরের ওপরে ৩২ লাখ ৪৬ হাজার ৭০৪ জন মানুষ করোনাভাইরাসের টিকা নিয়েছেন। অর্থাৎ সিটি করপোরেশন এলাকায় টিকা পাওয়া মানুষের হিসাবের সাথে পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া জনসংখ্যার হিসাব কাছাকাছি রয়েছে। পরবর্তীতে তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করে একই তথ্য জানতে চাওয়া হয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাস্থ্য বিভাগের কাছে। আবেদনের প্রেক্ষিতে তারা জানায়— চসিক এলাকায় করোনা টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছে ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৫৬৭ জন। 

অন্যদিকে, জাতিসংঘের পরিসংখ্যান বিভাগের অফিসিয়াল ওয়েবপোর্টালে (http://data.un.org) ২০২৩ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকার মোট জনসংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছে ৩২ লাখ ৩০ হাজার ৫০৭। তাছাড়াও জেলা নির্বাচন কমিশনের দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের হালনাগাদ তথ্যমতে, চট্টগ্রাম শহরের ভোটার সংখ্যা ২০ লাখ ৬৭ হাজার। 

আট মাসে জনসংখ্যা বেড়েছে ৪০ লাখ !

গত ১০ বছরে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ১৩টি অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এর মধ্যে আটটির কাজ শেষ হয়েছে এবং পাঁচটি চলমান। এসব প্রকল্পের মোট ব্যয় ৭ হাজার ৬৫২ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ছয়টি প্রকল্পের নথি ধরে অনুসন্ধান চালানো হয়। এসব উন্নয়ন প্রকল্পের নথিতে জনসংখ্যার ‘গোঁজামিল‘ খুঁজে পাওয়া গেছে। সেখানে দেখা যায়, একেক প্রকল্পে নিজেদের সুবিধামতো একেক ধরনের ‘জনসংখ্যা’ দেখিয়ে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) তৈরি করে, মন্ত্রণালয় থেকে পাশ করিয়ে এনেছে সংস্থাটি। 

২০১৬ সালের নভেম্বরে ৭১৬ কোটি ২৮ লাখ ৫০ হাজার টাকার নেয়া ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তাসমূহের উন্নয়ন এবং নালা, প্রতিরোধ দেয়াল, ব্রিজ ও কালভার্ট এর নিমার্ণ/পুননির্মাণ’ নামের প্রকল্পটিতে চট্টগ্রাম মহানগরীর জনসংখ্যা দেখানো হয় ৬০ লাখ ৮০ হাজার ৮৪৯ জন। অথচ ওই একই সময়ে পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মতে চট্টগ্রাম মহানগরীর জনসংখ্যা ছিল মাত্র সাড়ে ২৮ লাখ, যা সিটি কর্পোরেশনের হিসাবের চেয়েও প্রায় ৩৩ লাখ কম। 

বিস্মিত হতে হয় ৮ মাস পরে নেয়া আরেকটি প্রকল্পের ডিপিপি দেখে! ২০১৭ সালের জুলাইতে নেয়া ৩৮২ কোটি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকার সেই প্রকল্পের নাম—‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সড়ক এবং ব্রিজসমূহের উন্নয়নসহ আধুনিক যান যন্ত্রপাতি সংগ্রহ ও সড়ক আলোকায়ন’। সেখানে চট্টগ্রামের জনসংখ্যা এক লাফে বেড়ে হয় এক কোটি। অর্থাৎ মাত্র আট মাসের ব্যবধানে শহরের জনসংখ্যা বেড়েছে ৪০ লাখ। ২০১৮ সালেও একইভাবে ১ হাজার ২৩০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘মহানগরীর বিভিন্ন ওয়ার্ডের সড়ক নেটওয়ার্ক উন্নয়ন এবং বাস-ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ’ নামের প্রকল্পেও জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে প্রায় এক কোটি।

মজার তথ্য হচ্ছে, জনসংখ্যার এই হিসাব আবার কমিয়েও দেখিয়েছে চসিক। পরের বছর ২০১৯ সালেই সেটি ঘটেছে। ‘মর্ডানাইজেশন অব সিটি স্ট্রিট লাইট সিস্টেম অ্যাট ডিফারেন্ট এরিয়া আন্ডার চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন’ নামের এই প্রকল্পে প্রায় ২৬১ কোটি টাকা খরচ করে শহরে এলইডি বাতি লাগানো হয়। প্রকল্পটির নথিতে দেখা যায়, শহরের জনসংখ্যা এক কোটি থেকে এক বছরে এক লাফে নেমে হয়েছে ৫০ লাখ। জনসংখ্যার প্রায় একই রকম হিসাব তুলে ধরা হয়েছে তিন বছর পরের ২০২২ সালের ‘লোকাল গভর্নমেন্ট কোভিড রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রজেক্ট (সিআরআরপি)’ নামের আরেকটি প্রকল্পে। 

স্বাভাবিক কারণেই প্রশ্ন ওঠে এই দুটি প্রকল্পে লোকসংখ্যা কেন কম দেখালো চসিক? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেছে, প্রথম প্রকল্পটির অর্থায়ন করেছে ভারত সরকার পরেরটি বিশ্বব্যাংক। অর্থাৎ সরকারি বরাদ্দের বিভিন্ন ধরনের প্রকল্পে চসিক জনসংখ্যা ‘বাড়িয়ে’ দেখালেও বিদেশি অর্থায়নে নেওয়া প্রকল্পের ক্ষেত্রে ‘বেশি বাড়িয়ে’ দেখায় না। অবশ্য ‘কমিয়ে দেখানো’র পরও এসব প্রকল্পের জনসংখ্যা সেই সময়ের বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেওয়া হিসাবের চেয়ে প্রায় ১৫ লাখ বেশি ছিল। 

 ২০১৬ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত চসিকের নেওয়া উন্নয়ন প্রকল্পে শহরের জনসংখ্যার তথ্য যত দেখানো হয়।

প্রকল্প প্রণয়নের সময় চট্টগ্রাম মহানগরীর জনসংখ্যা নিয়ে সিটি করপোরেশন কেন এমন চাতুর্য্যের আশ্রয় নেয়— এই প্রশ্নের জবাবে সংস্থাটির সাবেক অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মনিরুল হুদা বলেন, ‘সরকারি বরাদ্দ, বিভিন্ন প্রকল্প এবং বাজেটের ক্ষেত্রে জনসংখ্যাকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়। কারণ সরকারের দেওয়া প্রকল্পে এই তথ্যটা যাচাই-বাছাই করা হয় না। কেবলমাত্র বিদেশি দাতা সংস্থার অর্থায়নে কোনো প্রকল্প নেওয়া হলে সেসময় জনসংখ্যা বা উপকারভোগীর তথ্য নিয়ে মাথা ঘামানো হয়। কারণ এ বিষয়ে তাদের (দাতা সংস্থার) শর্ত দেওয়া থাকে। এরপরও কিন্তু প্রকল্পে মনগড়া তথ্যের ব্যবহার করে সিটি করপোরেশন।’

শুধু একেক প্রকল্পে একেক রকমের জনসংখ্যা দেখানো নয়; একই প্রকল্পে দুই রকমের জনসংখ্যার হিসাব উপস্থাপনের নজিরও খুঁজে পাওয়া গেছে। যেমন, ২০১৭ সালের জুলাইয়ে ৩৮২ কোটি ১৯ লাখ ৪৪ হাজার টাকার একটি প্রকল্পে নগরীর জনসংখ্যা অর্থাৎ প্রকল্পের সুবিধাভোগী জনগোষ্ঠী দেখানো হয়েছে এক কোটি— যা প্রকল্পের ডিপিপির ১৩ পৃষ্ঠার ১৫.৬ অনুচ্ছেদে উল্লেখ রয়েছে। আবার এই প্রকল্পের ফিজিবিলিটি স্টাডিতে জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ৬০ লাখ ৮০ হাজার ৮৪৯ জন— যা উল্লেখিত রয়েছে ডিপিপির ৮৯ ও ৯০ পৃষ্ঠায়। 
 
প্রকল্পে এমন ’ভুতুড়ে’ জনসংখ্যার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে বিস্ময় প্রকাশ করে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘জনসংখ্যার এমন বিশাল ভ্যারিয়েশন এই প্রথম আপনার কাছ থেকেই জানলাম। এর আগে জানতামই না। আমাদের লিডাররা বলতে বলতে হয়তো এমন হয়ে গেছে।’ 

যত মানুষ, তত লাভ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কর্তারা বাড়তি মানুষ দেখানোকে ‘ভুল’ বললেও সেটি ছিল ‘ইচ্ছাকৃত’ ভুল। বিষয়টি পরিস্কার হয় বিশ্বব্যাংকের ঋণ সহায়তায় করা স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ২৬৭ কোটি টাকার ‘লোকাল গভর্নমেন্ট কোভিড রেসপন্স অ্যান্ড রিকভারি প্রজেক্ট’ (এলজিসিআরপি) নামের প্রকল্পটির দিকে তাকালে। এই প্রকল্প থেকে কোতোয়ালী থানার আন্দরকিল্লার মোমিন রোডের, চেরাগি পাহাড় মোড় থেকে লালদিঘি মোড়ের দিকে যেতে ৭৬২ মিটার ফুটপাতের সংস্কারের জন্য ২৫ লাখ টাকা বরাদ্দ পায় চসিক। চান্দগাঁও থানা এলাকার মোহরা ওয়ার্ডের আরাকান রোডে, আরো কম দৈর্ঘ্যের ৭৩০ মিটার ফুটপাতের সংস্কারের জন্য একই তহবিল থেকে চসিককে বরাদ্দ দেয়া হয় ৩ কোটি টাকা। একই ধরনের, একই মাপের সংস্কার কাজে দুই কোটি ৭৫ লাখ টাকা বেশি খরচ হয়েছে শুধু জনসংখ্যার হিসাবের হেরফেরের কারণে! প্রকল্পে মোমিন রোডের ফুটপাত ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা দেখানো হয় ৩৮ হাজার ৪০৯ জন; অপরদিকে আরাকান রোডের ফুটপাত ব্যবহারকারী মানুষের সংখ্যা ১ লাখ ৩৩ হাজার দেখানো হয়েছে। কেবল এ দুটি সড়কের ফুটপাতই নয়, উন্নয়ন প্রকল্পের সবখাতেই জনসংখ্যার কম বেশির কারণে ব্যয়ের তারতম্য দেখা গেছে। 

এ প্রসঙ্গে ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন বাংলাদেশের (আইইবি) চট্টগ্রাম কেন্দ্রের সাবেক চেয়ারম্যান প্রকৌশলী দেলোয়ার মজুমদার বলেন, ‘সরকার একদিকে বলছে নির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর প্রকল্প প্রণয়ন করো, আরেকদিকে অনির্ভরযোগ্য তথ্যের উপর প্রকল্প পাস করে দিচ্ছে। এভাবে প্রকল্প নেওয়াটাই অপরাধ, যা দুর্নীতির পর্যায়ে পড়ে। এই অনিয়মের দায়-দায়িত্ব শুধু প্রকল্প প্রণেতার নয়, যারা অনুমোদনের সঙ্গে জড়িত তাদেরও দায় দায়িত্ব আছে।’

যদিও ‘জনসংখ্যা নীতি ২০১২’ এবং ‘সরকারি খাতে উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ, অনুমোদন ও সংশোধন নির্দেশিকায়’ জনসংখ্যার সুনির্দিষ্ট তথ্য-উপাত্ত ও উপকারভোগী জনসংখ্যার ডিজিটাল ডাটাবেজ এবং সেই তথ্যের উৎস সঠিকভাবে অর্ন্তভুক্ত করতে বলা হয়েছে; যা ওই নির্দেশিকার ১.১.৮.১ অনুচ্ছেদ, ১.১.৯ অনুচ্ছেদ এবং ১.১.১৩ অনুচ্ছেদে উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু জনসংখ্যার নির্ভরযোগ্য সরকারি তথ্য প্রকল্পগুলোর ডিপিপিতে কখনো ব্যবহার করেনি চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন। 

একটি উন্নয়ন প্রকল্পে মানুষের সংখ্যা কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা জানতে কথা হয় চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ (সওজ), চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) শিক্ষক এবং প্রকল্প পরিচালকসহ ১৫ জন প্রকৌশলীর সঙ্গে। তাঁদের প্রত্যেকেই রাস্তাঘাট নির্মাণ কিংবা অন্যান্য প্রকল্পের ক্ষেত্রে জনসংখ্যা কম-বেশির ওপর বরাদ্দের বড় প্রভাব আছে বলে মন্তব্য করেছেন। 

এদিকে, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এ পর্যন্ত যত উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে তার বেশিরভাগই ছিল অবকাঠামোগত উন্নয়ন, রাস্তাঘাট নিমার্ণ ও সংস্কার, ড্রেনেজ সিস্টেমের উন্নয়ন ও জলাবদ্ধতা নিরসন সংক্রান্ত প্রকল্প।

প্রকৌশলীরা বলেছেন— যে এলাকার জনসংখ্যা বেশি হয়, সেই এলাকার স্থাপনাও বেশি হবে, আবার যানবাহনও বেশি চলবে। যত বেশি সংখ্যক ভারি যানবাহন চলাচল করবে, সেখানে স্বাভাবিকভাবে সড়কের অবকাঠামোগত ব্যয়ও বাড়বে। একইসাথে ভূমি অধিগ্রহণের বিষয় থাকলে তার ব্যয়ও বেড়ে যায়। তাছাড়া কখনও কখনও ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে এলাকাভেদে এ ব্যয়ের হার কম-বেশিও হয়।

এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘এগুলো হচ্ছে তাদের গাফিলতি। তাদের (চসিক) কোন তথ্যটা সত্য? ৭০ লাখ নাকি ১ কোটি? এখন ৭০ লাখের বেশি বলছে তা কোন সালের সার্ভে অনুসারে? পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যই হচ্ছে নির্ভরযোগ্য তথ্য। কারণ এটাই সরকারি তথ্য। দুই তিন বছর সময়ের ব্যবধানে ১০ শতাংশ এদিক সেদিক হতে পারে। চাইলেই তো কোন সংস্থা মনগড়া তথ্য দিতে পারেন না।’

ব্যতিক্রম শুধু চসিক

সিটি কর্পোরেশনের পাশাপাশি চট্টগ্রাম শহরের অন্যান্য সেবা সংস্থাগুলোও বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করে থাকে। নগরবাসীকে প্রত্যক্ষ সেবাদানকারী আরেকটি প্রতিষ্ঠান হলো চট্টগ্রাম ওয়াসা। তাদের কয়েকটি প্রকল্পের কাগজ-পত্র ঘেঁটে দেখা যায়, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া জনসংখ্যার হিসাবকে ভিত্তি ধরে চট্টগ্রাম শহরের জনসংখ্যা দেখায় সংস্থাটি। ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৪৮৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া কর্ণফুলী পানি সরবরাহ প্রকল্পে (ফেজ-২) ২০১১ সালের আদমশুমারী তথ্য অনুসারে শহরের জনসংখ্যা দেখানো হয়েছে ৩৯ লাখ ৬৪ হাজার। 

এ বিষয়ে চট্টগ্রাম ওয়াসার প্রধান প্রকৌশলী মাকসুদ আলম বলেন, ‘যেকোনো প্রকল্পের ক্ষেত্রে অবশ্যই সরকারি তথ্য ধরে কাজ হয়। সিটি করপোরেশনের জনসংখ্যার তথ্য নিয়ে আমাদের কোনো প্রকল্প নেওয়া হয়নি। নিয়ম অনুযায়ী আমরাও পরিসংখ্যার ব্যুরোর তথ্য ধরে কাজ করি।’ তিনি আরো জানান, শহরের মানুষের সংখ্যা বা উপকারভোগীর সংখ্যা বাড়লে প্রকল্পের ব্যয়ও বাড়ে। 

প্রকল্পে জনসংখ্যার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ ‘প্যারামিটার’— এমন মন্তব্য করে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী শেখ নাবিল দীপ বলেন, ‘টেকনিক্যালি মনে হবে সরাসরি জনসংখ্যার ভূমিকা নেই কিংবা মাথাপিছু মানুষ গুণে প্রকল্প নেওয়া হয় না। কিন্তু সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দু এই মানুষ বা জনসংখ্যা। জনসংখ্যাকে কেন্দ্র করেই কিন্তু সমস্ত প্রকল্প বা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়।’

চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ এই সেবা সংস্থার মতো দেশের অন্য সিটি করপোরেশনও কি বাড়তি জনসংখা দেখিয়ে বেশি বরাদ্দ আনে—এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে সরকারি ওয়েবসাইট থেকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন এবং রংপুর সিটি কর্পোরেশনের বাস্তবায়িত দুটি প্রকল্পের নথি জোগাড় করা হয়। সেখানে দেখা যায়, পরিসংখ্যান ব্যুরোর দেয়া জনসংখ্যাকে ভিত্তি ধরেই তারা প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। তবে বাকি ১০টি সিটি কর্পোরেশনের তথ্য যাচাই করা সম্ভব হয়নি। 

নগর-গবেষক, সেন্টার ফর আরবান স্টাডিজের (সিইউএস) সভাপতি অধ্যাপক নজরুল ইসলাম সব প্রকল্পে সিটি কর্পোরেশনের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য মানা উচিত উল্লেখ করে বলেন, ‘পরিকল্পনা কার জন্য? অবশ্যই জনগণের জন্য, এলাকার জন্য। একই কর্তৃপক্ষ তিনটা প্রকল্পে তিন রকমের জনসংখ্যা দেখালে হবে না। এটা যৌক্তিক না। প্রকল্প যারা অনুমোদন করে তাদের দায়িত্ব এসব চেক করা।’

চসিকের দাবি ‘সামান্য ভুল’!

জনসংখ্যার এই হিসাবের গোঁজামিল কবে থেকে দিচ্ছে তা জানতে, গত ১০ বছরে চসিকের নেয়া সকল প্রকল্পের ডিপিপি ‘র নথি চেয়ে ২০২৩ সালের ২০ নভেম্বর তথ্য অধিকার আইনে আবেদন করা হয়। এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত সেই আবেদনের সাড়া দেয়নি চসিক। 

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকেও কয়েকদফা চেষ্টার পর বিষয়টি নিয়ে কথা বলার সুযোগ মেলে। তিনি পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘জনসংখ্যার’ তথ্য ভুল দাবি করে বলেন, ‘আমাদের এখানে বাস্তবতার নিরিখে দেখা হইছে। তাই প্রকল্পে ব্যবহার করা হইছে। এখন এটা যদি মিথ্যা হয় তাহলে তারা প্রমাণ করুক। তখন যদি ৩৪ লাখের বেশি না হয়ে ৭০ লাখ হয়?’ 

চসিকের দাবিকৃত জনসংখ্যার ভিত্তি কী সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে মেয়র বিরক্ত মুখে বলেন, ‘যেহেতু একটা সংস্থা আছে। গবেষণা তারাই করবে। আমাদের গবেষণা নাই। সরকার উনাদেরকে (পরিসংখ্যান ব্যুরো) গবেষণা করার জন্য দিয়েছেন। উনাদেরটা ভুল বলেই আমরা ৭০ লাখ বলছি। আমাদের কোনো ভুল নাই।’ 

‘ভুল জনসংখ্যার’ হিসেবে নগরবাসীকে সেবা দিতে গত পাঁচ বছরে যত টাকা খরচ করেছে চসিক (তথ্যসূত্র: বাজেট বই)

তবে ভুল স্বীকার করেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। যদিও তিনি দাবি করেন, ‘জনসংখ্যার সাথে প্রকল্প ব্যয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।’ 

তাহলে কেন একেক প্রকল্পে একেক ধরনের জনসংখ্যা তুলে ধরা হয়- এমন প্রশ্নে তিনি কিছুটা বিব্রত হয়ে বলেন, ‘ভুলটা সিটি কর্পোরেশনের না। যারা ফিজিবিলিটি রিপোর্ট করেছে তাদের। এই দায় আমরা নেবো কেন?’ 

ফিজিবিলিটি স্টাডির অনুমোদন আপনার হাতেই হয়ে থাকে – এটা স্মরণ করিয়ে দেয়ার পর তিনি বলেন, ‘প্রকল্প নেবো কি নেবো না, সেটার জন্য মানুষের সংশ্লিষ্টতা আছে। প্রকল্প নিয়ে ফেললে মানুষের বিষয় আসতেছে না। তখন ইঞ্জিনিয়ারিং ডিজাইন অনুযায়ী যা আসবে তাই খরচ হবে। এটা সামান্য ভুল। আসলে মূল হচ্ছে ফিজিবিলিটি স্টাডি। ডিপিপি ভুল হইতে পারে।’ 

কিন্তু ফিজিবিলিটি স্টাডির প্রতিবেদনেও যে অসঙ্গতি আছে সেই নথি দেখালে তিনি আবারও সুর পাল্টে বলেন, ‘যারা স্টাডি করেছে তারাই বলতে পারে। আমরা থার্ড পার্টিকে টাকা দিয়ে করাই। আমরা নিজেরা যাচাই-বাছাই করি না। এটার দায় কনসালটেন্ট ফার্মের, আমাদের না।’’ 

কোন কনসালটেন্ট ফার্মের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছেন সে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি জানেন না বলে এড়িয়ে যান এবং নির্বাহী প্রকৌশলী জসীম উদ্দিনকে দেখিয়ে দেন।

ভূতুড়ে জনসংখ্যা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলামও কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। পরবর্তীতে ডিপিপি প্রণয়নকারী কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনার কথা অনুযায়ী এটা অনিয়ম। কিন্তু ডিপিপি কীভাবে তৈরি করে তা আমার জানা নেই। আমার সময়ে হয়নি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানতে হবে তারা কোন তথ্যের ভিত্তিতে প্রকল্প নিয়েছেন। এই মুহূর্তে টু দি পয়েন্ট উত্তর দিতে পারছি না।’

চসিকের ডিপিপি মাস্টার! 

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের এখন প্রায় সব উন্নয়নমূলক প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন করেন পুরকৌশল বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী জসীম উদ্দিন। ২০১৩ সাল থেকে চসিকের উন্নয়ন প্রকল্পের ডিপিপি তৈরি করেছেন এ কর্মকর্তা। শহরের জনসংখ্যার হিসাবে যে গোঁজামিল আমরা খুঁজে পেয়েছি, সেই ডিপিপিগুলো এই কর্মকর্তারই তৈরি করা। 

প্রতিটি প্রকল্প নেওয়ার আগে ফিজিবিলিটি স্টাডি বা সম্ভাব্যতা যাচাই করতে হয়। অথচ এই নির্বাহী প্রকৌশলীর বিরুদ্ধে সম্ভাব্যতা যাচাই না করেই ‘মনগড়া ফিজিবিলিটি স্টাডির তথ্য’ দিয়ে প্রকল্প প্রণয়ন করার অভিযোগ দীর্ঘদিনের। জানা গেছে, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের (এলজিইডি) কর্মকর্তাদের ‘ম্যানেজ’ করে প্রকল্প পাস করিয়ে আনার কারণে চসিকে তার ক্ষমতার দাপটও বেশি। 

 গত পাঁচ বছরে ডিপিপি তৈরিতে যত টাকা খরচ করেছে চসিক (তথ্যসূত্র: বাজেট বই)

চসিকের প্রকৌশল বিভাগের এক নির্বাহী প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘২০০৬ সালে সড়ক পরিদর্শক হিসেবে অস্থায়ীভাবে নিয়োগ পান তিনি (জসীম উদ্দিন)। এরপর ২০০৯ সালে বিভাগের ১১ সিনিয়র কর্মকর্তাকে বাদ দিয়ে তাকে বানানো হয় নির্বাহী প্রকৌশলী। উনি যে মন্ত্রণালয়ে টাকা দিয়ে প্রকল্প পাস করাই আনে সেটা এখানে ওপেন সিক্রেট। সবাই জানে। উনাকে ডিপিপি মাস্টার ডাকা হয়। ’

এছাড়া জসীম উদ্দিন ‘চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আওতায় বিমানবন্দর সড়কসহ বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগত উন্নয়ন’ প্রকল্পের উপপ্রকল্প পরিচালক পদের দায়িত্বে আছেন। এটি চসিকের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় প্রকল্প। এতে খরচ হচ্ছে ২ হাজার ৪৯৯ কোটি টাকা। সম্প্রতি দুর্নীতি দমন কমিশনও (দুদক) আনুষ্ঠানিকভাবে চার মাস ধরে তদন্ত-অনুসন্ধান চালিয়ে এই প্রকৌশলী ও তাঁর স্ত্রীর নামে আয়বহির্ভূত বিপুল অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রমাণও পেয়েছে। গেলো মাসে শেষ করা দুদকের সেই তদন্ত প্রতিবেদনটি সিভয়েস ২৪-এর হাতেও এসেছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, জসীম উদ্দিনের প্রায় দুই কোটি টাকার অবৈধ সম্পদের খোঁজ পেয়েছে দুদক।    

এই প্রতিবেদন করতে গিয়ে কয়েক দফা নির্বাহী প্রকৌশলী জসীম উদ্দিনের সাক্ষাৎকার চাওয়া হয়। কোনভাবেই তিনি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে চাচ্ছিলেন না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসিয়ে রেখেও সাক্ষাৎ দেননি। গত ২৫ জানুয়ারি দুপুরে তার রুমের সামনে জসীম উদ্দিনের দেখা পেলে সরাসরি সাক্ষাৎকার চাওয়া হয়। কিন্তু প্রতিবেদকের মুখোমুখি না হয়ে রুমের দরজা বন্ধ করে রাখেন তিনি। ২৫ মিনিট অপেক্ষার পরে এক পর্যায়ে রুম থেকে বের হন এই প্রকৌশলী। ‘ভূতুড়ে’ জনসংখ্যার প্রসঙ্গ টেনে তাকে প্রশ্ন করতেই তিনি তড়িঘড়ি করে সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলেন, ‘চিফের সঙ্গে কথা বলে দিবো। এখন দিতে পারবো না। আপনি পরে আসেন। এ বিষয়ে চিফের সঙ্গে কথা বলেন।` সর্বশেষ ৬ ফেব্রুয়ারি আবারও চসিকে তার মুখোমুখি হলে তিনি ‘মিটিং আছে’ বলে এড়িয়ে যান।  

যাদের দেখার কথা তাঁরাই ঘুমে!

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন শহরের জনসংখ্যার সংখ্যা নিয়ে নয়ছয় করে তা পরিকল্পনা কমিশনেরও অজানা নয়! সাত বছর আগে ২০১৬ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় চসিকের জনসংখ্যার হিসাবে গোঁজামিল ধরা পড়ে। ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন বন্যা ও জলাবদ্ধতায় ক্ষতিগ্রস্থ রাস্তাসমূহের উন্নয়ন এবং নালা, প্রতিরোধ দেয়াল, ব্রিজ ও কালভার্ট এর নিমার্ণ/পুননির্মাণ’ নামের প্রকল্পের যে ডিপিপি চসিক তৈরি করে সেটিতে প্রথমে চট্টগ্রাম মহানগরীর জনসংখ্যা দেখানো হয় ৯২ লাখ ১০ হাজার। পিইসি’র আপত্তির মুখে ডিপিপি সংশোধন করে চসিক সেই প্রকল্পের জন্য শহরের জনসংখ্যা দেখায় ৬০ লাখ ৮০ হাজার ৮৪৯ জন। যদিও সংশোধন করার পরের তথ্যও ছিল ভুল। তবে এই ঘটনার পর থেকে সিটি করপোরেশন নতুন ‘কৌশল’ নেয়। ডিপিপি’তে আলাদাভাবে ওয়ার্ডভিত্তিক জনসংখ্যা না দেখিয়ে একেবারে মোট জনসংখ্যা বা উপকারভোগীর সংখ্যা দেখানো শুরু করে।

তথ্য অধিকার আইনে তথ্য চাওয়ার পর চসিকের সরবরাহ করা ওয়ার্ডভিত্তিক জনসংখ্যার তথ্য এবং জনসংখ্যার ভুল নিয়ে পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তির প্রমাণ।

বাস্তবায়ন, পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের পরিচালক মুহাম্মদ শাহাদাত হোসাইনকে ডিপিপি’তে চসিকের মনগড়া জনসংখ্যার হিসাব তুলে ধরার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এটার দায়-দায়িত্ব সিটি কর্পোরেশনের। স্থানীয় সরকার বিভাগেরও দেখা উচিত। আর আমাদেরও দায়িত্ব আছে। তবে প্রকল্প অনগোয়িং (চলমান) হওয়ার পর আমরা মনিটরিং করি। সেক্ষেত্রে শুরুতেই দেখে পরিকল্পনা কমিশন। তাদের অনুমোদনের পরে দেখার বিষয় থাকে। আমি আসার পরে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কোনো প্রকল্প এখনো অনুমোদন করিনি। পরবর্তীতে এই বিষয়টা অবশ্যই গুরুত্ব সহকারে দেখবো।’

একই বিষয়ে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) ড. মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন , ‘এটা নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সঙ্গে কথা বলা উচিত। আমরা এসব দেখিনা। আমার কথা বলারও কিছু নাই। যদি স্পেসিফিক কিছু থাকে বলতে পারেন তাহলে আমাদের জন্য হেল্পফুল হবে।’

জনসংখ্যার ভুল তথ্য বড় অনিয়ম উল্লেখ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘এখানে একটা শুভংকরের ফাঁকি ও সুক্ষ্ণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জালিয়াতি, অনিয়ম-দুর্নীতি করা হচ্ছে। যারা এর সাথে জড়িত,তারা যেহেতু কোনো না কোনোভাবে প্রভাবশালী, ফলে নির্বিকারভাবে ঘটনাগুলো ঘটে যাচ্ছে। যেহেতু একই কর্তৃপক্ষ তাদের বিভিন্ন প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের জনসংখ্যার তথ্য দেখিয়েছে, এ থেকে খুবই সহজে অনুমেয় যে এখানে দুর্নীতি হয়েছে।’

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)-এর দুর্নীতিবিষয়ক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা ফেলোশিপ— ২০২৩ এর আওতায় প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়