Cvoice24.com

জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের গ্রন্থাগার নিজেই জাদুঘরে!

শারমিন রিমা

প্রকাশিত: ০৯:৩৬, ১৮ মে ২০২২
জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের গ্রন্থাগার নিজেই জাদুঘরে!

জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের গ্রন্থাগার

দেয়ালের পলেস্তার খসে পড়া দোতলা অফিস ভবনের এককোণের ছোট্ট একটা রুম। তাও তালাবদ্ধ। দরজা খুলতেই জমে থাকা ধুলো আর ভ্যাপসা গন্ধ যেন মুক্তির আনন্দে সাদরে বরণ করে নিল। রুমের হালচাল দেখে বোঝা যাচ্ছে গোটা বছর দুয়েক পা পড়েনি কারও। ধুলো জমা ও ঝুলেভরা ওই রুমের আসবাব বলতে বই ভর্তি পাঁচটা কাঠের আলমারি, দুটো স্টিলের আলমারি, একটা পুরাতন কাঠের টেবিল আর চারটা চেয়ার। যদিও সেই চেয়ারে বসবার জো নেই। আর ধুলোবালি জমা এই ছোট্ট রুমটিই চট্টগ্রামের জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের একমাত্র গ্রন্থাগার (লাইব্রেরি)। 

দেশি-বিদেশি দর্শকদের জ্ঞানানু সন্ধানের আকাঙ্ক্ষাই গড়ে তোলা একতলা বিশিষ্ট দক্ষিণমুখি এই জাদুঘর থেকে খানিক দূরেই লাইব্রেরিটি। অনেকটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতন। এ যেন জাদুঘরের ভেতরেই আরেক জাদুঘর। অথচ জাদুঘরে আগত দর্শনার্থীদের ৯৫ শতাংশই জানে না এইখানে একটি লাইব্রেরি আছে। 

বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিলুপ্ত প্রায় জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব আঁকড়ে রাখার প্রয়াসেই ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের আগ্রাবাদে নির্মিত হয়েছিল জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘর। তার ভেতরেই কতটা নিধারুণ অযত্নে অবহেলায় আলমারিতে পড়ে আছে প্রায় এক হাজার ৫০০ বই। কিন্তু সে খবর রাখে না স্বয়ং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরই। যদিও জাদুঘর কর্তৃপক্ষের দাবি, সংস্কারকাজের জন্য সাময়িকভাবে সরিয়ে রাখা হয়েছে। তবে বছরের পর বছর এভাবেই তালা বদ্ধ হয়ে পড়ে ছিল লাইব্রেরিটি।

সরেজমিনে জাদুঘর ঘুরে দেখা যায়, জাদুঘরে জায়গার স্বল্পতার কারণে সংগৃহিত অধিকাংশ নিদর্শনগুলো গ্যালারিতে প্রদর্শন করা সম্ভব হয়নি। প্রায় দুই হাজার নিদর্শন লাইব্রেরির পাশের স্টোরে সংরক্ষিত রয়েছে। কিন্তু সেসবেও যথেষ্ট অবহেলার ছাপ রয়েছে। ধুলোবালি জমে যা নষ্ট হবার পথে। 

জাদুঘরের লাইব্রেরি ঘুরে দেখতে চাইলে প্রথমদিকে তালা বন্ধ আছে, দেখা যাবে না বললেও প্রতিবেদকের পরিচয় জানাতে এবং অনেক অনুরোধের পর গবেষণা সহকারি কর্মকর্তা আবু বকর সিদ্দিক লাইব্রেরিটি ঘুরিয়ে দেখান। জাদুঘরের লাইব্রেরির এমন বেহাল দশা স্বীকার করে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘বেশিরভাগ মানুষজনই জানে না এখানে একটা লাইব্রেরি আছে। যদি জাদুঘরের হলরুমের পাশে লাইব্রেরি রাখার ব্যবস্থা থাকতো তাহলে দর্শনার্থীরা জানতে পারতো। এটা দূরে হওয়াতে দর্শনার্থীরা আসলে বঞ্চিত হচ্ছেন।’

তিনি আরও বলেন, ‘তবে গবেষণার কাজে কেউ এলে আমরা তাদের লাইব্রেরিতে আসতে দেই। তারা এখানে এসে বই পড়েন। কেউ কেউ আবার ফটোকপি করেও নেন। পলেস্তার খসে পড়ায় লাইব্রেরি রুমের কাজ চলছে তাই আপাতত বন্ধ রাখা হয়েছে। আমরা গতমাসে আরও কিছু সমস্যার কথা জানিয়ে চিঠি দিয়েছি আশা করি সামনে সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’

তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বছরকে বছর একই রকম পড়ে আছে সবকিছু। দর্শনার্থী আসবে কোথা থেকে? তার ওপর জাদুঘরের ছাদ দীর্ঘদিন সংস্কার না করায় বৃষ্টি হলে পলেস্তার খসে পানি পড়ে। এতে করে অনেক নিদর্শন নষ্ট হবার পথে। এর বাইরে জনবলের স্বল্পতা, অগ্রাধিকার তালিকায় কম গুরুত্ব ও বাজেটের সীমাবদ্ধতার কারণে এ জাদুঘরের চেহারা আর পরিবর্তন হয় না। আর এসকল কারণে জাদুঘরের পূর্ণাঙ্গতা নিয়েও হতাশা রয়েছে বিশেষজ্ঞ ও দর্শনার্থীদের।’

অন্যদিকে, ১৯৭৪ সালে সাধারণ দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করা হয় জাদুঘরটি। নির্মাণের পাঁচ দশক পেরিয়ে ৫৭ বছর ধরে জাদুঘরটিতে প্রদর্শিত হওয়া নিদর্শনগুলো বছরের পর বছর ধরে একইভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে। বর্তমানে জাদুঘরটিতে দেশের ২৩টি জাতিগোষ্ঠীর পাশাপাশি পাকিস্তানের কয়েকটি জাতিগোষ্ঠীর নিদর্শন রয়েছে। আলোকচিত্র, মডেল, নমুনার মাধ্যমে বাঙালি জাতিসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর জীবনযাপন, সাংস্কৃতিক আচার, পোশাক, অলংকারের নিদর্শনসহ জাতিগোষ্ঠীগুলোর নিজস্বতা তুলে ধরা হয়েছে। বর্তমানে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ৩ হাজার ২০০ এর মতো নিদর্শন আছে জাদুঘরটিতে। কিন্তু এসকল প্রাচীন নির্দশন প্রদর্শনে নতুনত্ব না থাকায় দর্শনার্থীর সংখ্যা বাড়ছে না বলে মন্তব্য বিশেষজ্ঞদের। 

জাদুঘর কর্তৃপক্ষ জানায়, জাদুঘরে গড়ে প্রতিদিন ২০০ করে দর্শনার্থী আসছেন। যেখানে দেশের অন্যান্য জাদুঘরে হাজার তিনেক দর্শনার্থী থাকে। দূর দূরান্ত থেকে দর্শনার্থী এলেও তাতে অভিযোগের অন্ত থাকে না।  

গত ২ মে দিনাজপুরের পার্বতীপুর থেকে জাতিতাত্বিক জাদুঘরে এসেছেন মো. আরিফুল ইসলাম। দর্শনার্থীদের মন্তব্যের খাতায় লিখেছেন, ‘প্রত্নতাত্বিক জাদুঘর ঘুরে আমি মোটেও সন্তুষ্ট হতে পারলাম না। কারণ এখানে তেমন কোনো ভালো জিনিস চোখে পড়লো না। আমাদের গ্রামে-গঞ্জে এর চেয়ে অনেক ভালো ভালো জিনিস পরিলক্ষিত হয়। আর কিছু বলতে চাই না। বলার অনেক ছিল।’

আরেক দর্শনার্থী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রহিমুল ইসলাম লিখেছেন, ‘যতবারই আসি ঠিক পূর্বের জিনিসগুলোই। নতুন কোনো সামগ্রী সংগ্রহের কি কোন উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে না। শুভংকরের ফাঁকি।’

এসকল বিষয়ে জানতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক লাভলী ইয়াসমিনের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁর কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি।

এদিকে ‘পাওয়ার অব মিউজিয়াম’প্রতিপাদ্য নিয়ে আজ ১৮ মে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবস। প্রতিবছরই একটি শ্লোগান সামনে রেখে এ দিবসের তাৎপর্য তুলে ধরা হয়- যাতে ছাত্র, শিক্ষক, গবেষক ও পণ্ডিত ব্যক্তিদের গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি হয় এবং বিশ্ব নাগরিকরা জাদুঘর ও তার আপন ঐতিহ্য সম্পর্কে ভাবতে শেখে। সমাজ ও গোষ্ঠীর উন্নয়নে জাদুঘরের ভূমিকা ও গুরুত্বের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে জনসচেনতা বৃদ্ধির লক্ষেই প্রতিবছর আন্তর্জাতিক জাদুঘর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়।
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়