Cvoice24.com


তীব্র পানি সংকটে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০০ পরিবার

প্রকাশিত: ১৬:৪৭, ১৯ অক্টোবর ২০২০
তীব্র পানি সংকটে খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৬০০ পরিবার

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে উদ্ভাস্তু হওয়া মানুষগুলোর জন্য প্রধানমন্ত্রী গড়ে তুলেন খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প। কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র ৭ কিলোমিটার উত্তরে বাঁকখালী তীর ঘেঁষে নির্মিত দৃষ্টিনন্দন ভবনে স্থান হয়েছে ৬০০ পরিবারের। অনেক স্বপ্ন নিয়ে দালান কোঠায় ঠাঁই হওয়া মানুষগুলোর বড় দুঃখ এখন পানি। থাকার জন্য দৃষ্টিনন্দন ভবন পেলেও মেলেনি খাবারের পানির ব্যবস্থা। সঠিক সময়ে ব্যবহারের পানিও পাচ্ছে না খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দারা। এখানকার ৬০০ পরিবারের সদস্য তীব্র পানি সংকটে ভুগছে এখন। সুউচ্চ দালানে যে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে তা লবণাক্ত। পান তো দূরের কথা এই পানি ব্যবহারও করার মতো নয়। 

ঝিনুক ভবনের ৩০২ নং ফ্ল্যাটের বাসিন্দা মুহাম্মদ হোসেন (৩৭) জানান, শুরু থেকে তারা পানি নিয়ে খুব সমস্যায় আছে। কর্তৃপক্ষকে বলেও কাজ হয়নি। পূর্ব দিকে অনেক দূরে গিয়ে মনুপাড়া থেকে টমটমে করে খাবার পানি আনতে হয়।  তিনি জানান, সম্প্রতি এলাকার বখাটেরা ওখান থেকেও পানি আনতে গেলে বাধা দেয়। পথে গাড়ি আটকিয়ে চাঁদা দাবি করে। যে কারণে খাবার পানি নিয়ে পরিবারের ৬ সদস্য নিয়ে খুবই কষ্টে আছেন মুহাম্মদ হোসেন। 

একই অভিযোগ ১৯টি ভবনের প্রত্যেক ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের। তারা জানিয়েছে, ফ্ল্যাটে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা থাকলেও তা হয় ইচ্ছেমতো। প্রয়োজনের সময় পায় না। বেশকিছু দিন ধরে অবস্থা নাজুক। লাইনের পানি দিয়ে গোসল করা যাচ্ছে না।

ঝিনুক ভবনের ৫০১ নম্বর ফ্ল্যাটে স্ত্রী ও ২ সন্তান নিয়ে বসবাস সিরাজুল ইসলামের। ভবনের নীচে একটি ছোট্ট মুদির দোকান দিয়েছেন। অল্প আয়ে কোন মতে চলছে সংসার। কিন্তু ব্যবহারের পানি নিয়ে তার যত অভিযোগ। সিরাজুল ইসলাম জানান, প্রথমদিকে কিছু পানি সরবরাহ পেলেও এখন মারাত্মক অবস্থা। প্রতি বোতল পানি ৫০ টাকা করে কিনে খেতে হচ্ছে। তাতে কোনভাবে চললেও ব্যবহারের পানি নিয়ে পড়েছেন মহা বেকায়দায়। গোসল, অজু কালাম করতে গিয়ে আরো মারাত্মত দশা। সব মিলিয়ে খাবার ও ব্যবহারের পানি নিয়ে দুঃখের কোন শেষ নেই। 

একই অভিযোগ নীলাম্বরী ভবনের ৪০১ নং ফ্ল্যাটের হেলাল উদ্দিনের। তিনি দুঃখ করে বলেন, পানিতে আটকে গেছে তাদের সব সুখ। তার ছোট্ট একটি পরিবারে দিনে ৫০ টাকা হিসেবে মাসে ১ হাজারেরও বেশী পানির বিল দিতে হচ্ছে। অথচ পুরো মাসে ১০০০ টাকা আয়ও নাই। 

জেলা প্রশাসন সুত্রে জানা গেছে, আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিরাপদ পানি সরবরাহের লক্ষ্যে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৯৭২.০০ লক্ষ টাকার বৃহৎ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যার মধ্যে রয়েছে পাম্প হাউস ও পানি সরবরাহ লাইন স্থাপন। 

এ বিষয়ে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর কক্সবাজারের নির্বাহী প্রকৌশলী ঋত্ত্বিক চৌধুরী জানান, খাবার ও গোসলের পানির জন্য পৃথক দুইটি প্রস্তাবনা রয়েছে। অনেক বড় প্রকল্প দরকার। আপাতত সেলো মেশিন বসিয়ে সেখান থেকে পানি সরবরাহ করা হচ্ছে। এ জন্য ১ জন অপারেটর নিয়োজিত করা হয়েছে। 

তিনি জানান, সরবরাহের পানি লবণাক্ত হওয়ায় অনেকে ব্যবহার করতে পারেনা। এতগুলো লোকের পানির জন্য দীর্ঘস্থায়ী প্রকল্প নেয়া দরকার। তিনি আরো জানান, প্রকল্প থেকে ৮ কিলোমিটার দূরে পিএমখালী থেকে পানি আনার বিষয়ে পরিকল্পনা রয়েছে। তা বাস্তবায়ন কলে পানি সমস্যা দূর হবে মনে করেন প্রকৌশলী ঋত্ত্বিক চৌধুরী। 

এদিকে, খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাদের সমস্যাগুলো নিয়ে ১৮ আক্টোবর রাতে জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় জেলা প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসনের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। ফ্ল্যাটের বাসিন্দারা তাদের সব সমস্যার কথা তুলে ধরেন। বর্ণনা দেন স্থানীয় বাসিন্দাদের নির্যাতনের কথা। 

উল্লেখ্য, কক্সবাজার শহর থেকে মাত্র সাত কিলোমিটার উত্তরে বিশ্বের সর্ববৃহত্ত ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পে’র অবস্থান। গত ২৩ জুলাই গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রথম ধাপে তৈরি ২০টি ভবনের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যাতে স্থান হয়েছে ৬০০ জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের।

আশ্রয়ণ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর রামু ১০ পদাতিক ডিভিশন। এখানে নির্মাণাধীন ১৩৭টি পাঁচতলা ভবনের প্রতিটিতে ৬৫০ বর্গফুট আয়তনের ৩২টি করে ইউনিট (ফ্ল্যাট) থাকছে। সেখানে আশ্রয় নেবে ৩২টি করে পরিবার।

এ প্রকল্পে ১০ তলার আরেকটি দৃষ্টিনন্দন ভবন হচ্ছে। ভবনটির নামকরণ হয়েছে ‘শেখ হাসিনা টাওয়ার’। খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পে যাতায়াতের জন্য বাঁকখালী নদীর ওপর তৈরি হচ্ছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৯৫ মিটার দীর্ঘ সেতু ও সংযোগ সড়ক। ২০১৮ সালে কক্সবাজার বিমানবন্দরকে আন্তর্জাতিক মানের করতে সম্প্রসারণের কাজ শুরু হয়। রানওয়েসহ অন্যান্য অবকাঠামো তৈরির জন্য অধিগ্রহণ করতে হয়েছে বিমানবন্দরের পশ্চিম পাশ লাগোয়া কুতুবদিয়াপাড়া, ফদনারডেইল, নাজিরারটেক উপকূলের বিপুল পরিমাণ সরকারি খাসজমি। সেখানে এক যুগের বেশি সময় ধরে বসবাস করছিল চার হাজারের বেশি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার। 

১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে জেলার কুতুবদিয়া, মহেশখালী, চকরিয়া, পেকুয়াসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে ঘরবাড়ি হারিয়ে বিমানবন্দরের পাশে সমুদ্র উপকূলে আশ্রয় নিয়েছিলেন এসব গৃহহীন মানুষ। প্রধানমন্ত্রী কক্সবাজারে এসে জনসভায় ঘোষণা দিয়েছিলেন, মাথা গোঁজার বিকল্প ঠাঁই না করে সরকারি খাসজমি থেকে কাউকে উচ্ছেদ করা হবে না।

এরপর অধিগ্রহণ করা সরকারি খাসজমিতে বসবাসকারী ৪ হাজার ৪০৯ পরিবারের অন্তত ২০ হাজার জলবায়ু উদ্বাস্তুকে পুনর্বাসনের জন্য খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। প্রকল্পের জন্য খুরুশকুলে অধিগ্রহণ করা হয় ২৫৩ দশমিক ৩৫০ একর জমি। প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১৭ সালে।

এ পর্যন্ত পাঁচতলাবিশিষ্ট ১৯টি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়েছে। আরও একটি ভবনের নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে। এখন এসব ভবনে ফ্ল্যাট বরাদ্দ পেয়েছে ৬০০টি পরিবার। পরিবারগুলো অধিকাংশ শুঁটকিশ্রমিক, জেলে, ভ্রাম্যমাণ শুঁটকি বিক্রেতা, রিকশা ও ভ্যানচালক, যাদের দিন এনে দিন খেতে হয়। কয়েকটি পরিবার আছে ভিক্ষা করে চলে। প্রকল্পের একটি বিশেষ ব্যাপার হচ্ছে দৃষ্টিনন্দন ২০টি ভবনের নান্দনিক নামও দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই। 

নামগুলো হচ্ছে- দোলনচাঁপা, কেওড়া, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, কামিনী, গুলমোহর, গোলাপ, সোনালি, নীলাম্বরী, ঝিনুক, কোরাল, মুক্তা, প্রবাল, সোপান, মনখালী, শনখালী, বাঁকখালী, ইনানী এবং সাম্পান।

ইমাম খাইর, কক্সবাজার

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়