‘সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য পারুল’

প্রকাশিত: ১৩:১৬, ১৭ মার্চ ২০১৯
‘সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য পারুল’

স্বাক্ষর জালিয়তি করে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন চেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় সম্প্রতি কারাগারে যাওয়া হোসনে আরা পারুলের বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্ত নেই। দীর্ঘদিন পলাতক থেকে সর্বশেষ আদালতে হাজির হওয়ার পর তাকে কারাগারে প্রেরণের নির্দেশ দেন আদালত। কারাগারে যাওয়ার পর থেকে তার বিরুদ্ধে জমতে শুরু করে অভিযোগের পাহাড়।

ভুক্তভোগিরা প্রমাণপত্র নিয়ে পারুলের অত্যাচার থেকে বাঁচতে আদালত এবং গণমাধ্যম কর্মীদের সাহায্য চেয়েছেন। এমন একজন ভুক্তভোগির একটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদনে নগর গোয়েন্দা পুলিশ পারুলকে সংঘবদ্ধ অপরাধী চক্রের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেন।

মামলা করে ফাঁসলেন পারুল:

যে কাউকে হয়রানী করার জন্য ‘মামলা’কে প্রধান অস্ত্র হিসেবে বেছে নেন পারুল। আদালতে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে নারী নির্যাতন, মানহানি, হামলার অভিযোগে নামে-বেনামে মামলা দায়ের করে থাকেন তিনি। মামলাগুলোর বিচারকাজ এগুলে দেখা যায় প্রতিটি মামলার অভিযোগের সাথে বাস্তবের কোন মিল নেই। এমন একটি মামলার তদন্ত করতে গিয়ে কোতোয়ালী থানা পুলিশ এবং নগর গোয়েন্দা পুলিশ পারুলের মিথ্যা মামলা দায়েরের ঘটনা উল্লেখ করে আদালতে প্রতিবেদন দেন।

আদালত সূত্রে যায়, ২০১৭ সালের ২১ মে নগরীর কোতোয়ালী থানায় শেখ শহীদ হোসেন এবং মো. কাউসার উল্লাহ নামের দুই ব্যক্তিকে আসামি করে একটি মামলা দায়ের করেন হোসনে আরা পারুল। মামলার এজহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ১৭ মে চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম ৫ম আদালতে পাশে বারান্দায় এজাহার নামীয় দুই আসামি পারুলের গতিরোধ করে অশ্রাব্য ভাষায় গালিগালাজ ও মারধর করে অপহরণের চেষ্টা চালায়। আসামিরা এবং তাদের সঙ্গীয় দুশ্চরিত্র সন্ত্রাসী মহিলা অবিলম্বে তার (পারুলের) দায়েরকৃত সিআর মামলা ৬৯৮/১৬সহ অপরাপর মামলা তুলে না নিলে যে কোন সময় তাকে অপহরণ করে নির্যাতন করে হত্যা করার হুমকি প্রদান করেন।

এছাড়া এজাহারে আরো উল্লেখ করা হয়, মামলার ১ নম্বর আসামি শেখ শহীদ হোসেন এবং সিপি বাংলাদেশ কোং লি. এর ম্যানেজার রাকিবুল ইসলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের কথা বলে ঢাকার রমনা হোটেলে নিয়ে তাকে কু প্রস্তাব দেয়। তিনি (পারুল) কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানী করতে থাকে।

হোসনে আরা পারুলের দায়েরকৃত এই মামলাটি তদন্ত করে একই বছরের ১৭ সেপ্টেম্বর আদালতে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা এসআই নুরুল ইসলাম। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় ‘বাদীনি (হোসনে আরা পারুল) একটি সংঘবদ্ধ চক্রের সদস্যদের সাথে বিভিন্ন অপরাধমুলক কর্মকান্ডের সাথে জড়িত। বাদীনি ও বিবাদী কায়সার উদ্দিন এবং বিবাদী শহীদ হোসেন এর বন্ধু মিরসরাইয়ের সিপি বাংলাদেশ কোং লি. এর কর্মকর্তা রাকিবুল  ইসলাম বাদীনির পূর্ব হইতে বিভিন্ন মামলা চলিয়া আসিতেছে। রাবিকুল ইসলাম পরিচালিত সিপি বাংলাদেশ কোং লি. বিভিন্ন ব্যবসা থাকার সুযোগে বাদীনি তাহার বিভিন্ন অযুহাতে যাইতো। রাকিবুল ইসলামের সাইড চলাকালে অত্র মামলার বাদীনি রাকিবুল ইসলামের অফিসে যাইয়া বিরোধ সৃষ্টি করে। ওইদিন সিপি বাংলাদেশ কোং লি. এর রাকিবুল ইসলামের অফিস হতে তার নামীয় ইসলামী ব্যাংক লি. বারইয়ারহাট শাখার সঞ্চয়ী হিসাব নং ২১১৩৯ এর একটি চেক বই চুরি হয়ে যায়। রাবিকুল ইসলাম তাৎক্ষণিকভাবে ইসলামী ব্যাংকে অবগত করে চেকটি বাতিল করার ব্যবস্থা করেন। এই মামলার বাদীনি রাকিবুল ইসলাম হারিয়ে যাওয়া চক হতে চেক নং MSP ১৮৬০৪৭৯ এর তারিখ ০৬/০৯/১৬ এবং ২৮,০০,০০০/( আটাশ লাখ) টাকা উল্লেখ করে ইং ১৯/০৯/১৬ তারিখ ইসলামী ব্যাংক লি. বারইয়ারহাট শাখায় জমা দিয়ে উত্তোলন করার চেষ্টাকালে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ অত্র মামলার বাদীনি হোসনে আরা পারুলকে আটক করে। এতদ সংক্রান্তে রাকিবুল ইসলাম অত্র মামলার বাদীনি হোসনে আরা পারুল এর বিরুদ্ধে বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত-১, সিজেএম কোর্ট, চট্টগ্রাম আদালতে সিআর মামলা ৯৪/১৬ ধারা ৪২০/৪৬৭/৪৬৮/৪৭১ দঃবিঃ দায়ের করেন।

উক্ত বিষয়ে রাকিবুল ইসলাম এর বন্ধু হিসেবে অত্র মামলার বিবাদী শেখ শহীদ হোসেন সকল আইননানুগ কাজে সহায়তা করেন। বিবাদী শেখ শহীদ হোসেন রাকিবুল ইসলামকে সহায়তা করার কারণে বাদীনি রাকিবুল ইসলাম ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন হয়রানীমূলক মিথ্যা মামলা দায়ের করাসহ বিভিন্ন দপ্তরে মিথ্যা অভিযোগ দায়ের করে আসছে।

ভূয়া চেকে লেনদেন:

এই মামলার ২ নম্বর আসামি মো. কাউছার উল্লাহকেও ছাড়েনি হোসনে আরা পারুল।পাওনা টাকা আদায়ে চাপ প্রয়োগ করলে তাকে মামলা দিয়ে হয়রানী করে সে। কোতোয়ালী থানা পুলিশের তদন্ত কর্মকর্তা তার প্রতিবেদনে এমনটি উল্লেখ করেন। তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, অত্র মামলার অপর বিবাদী মো. কাউছার উল্লাহ (৩৯) একজন ব্যবসায়ী। তিনি জুবলী রোডে মেশিনারীজের ব্যবসা করেন। অত্র মামলার বাদীনি হোসনে আরা বেগম পারুল নিজেকে রাজনৈতিক দলের নেতা পরিচয় দিয়ে কাউছার উল্লাহ এর জুবলী রোডস্থ আহদ মেশিনারী নামীয় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হতে মামলামাল নিয়ে কাউছার উল্লাহ বাদীনির নিকট ১২ লাখ টাকা পাওনা হন। উক্ত টাকার বিপরীতে বাদীনি হোসনে আরা বেগম পারুল কাউছার উল্লাহকে ইসলামী ব্যাংক সিডিএ শাখার হিসাব নং-৩৪৯৮৫ এর চেক নং MSP-৮৯৪৭২৬৩ মুলে ১২ লাখ টাকা প্রদান করেন। যা ক্যাশ করার জন্য জমা দিলে ব্যাংক হতে জিঅনার হয় মর্মে বিজ্ঞ আদালতে সিআর মামলা নং ৬৬৮/১৭ (কোতোয়ালী) দায়ের করেন। মামলাটি দু’টি বিজ্ঞ আদালতে বিচারাধীন। অপর দিকে বাদীনি হোসনে আরা পারুলের বিরুদ্ধে আলহাজ্ব রহমত নামীয় জনৈক ব্যক্তি অত্র মামলার বাদীনি হোসনে আরা পারুল বিরুদ্ধে চেক প্রতারণা সংক্রান্তে বিজ্ঞ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আমলী আদালত, চট্টগ্রাম এ সিআর মামলা নং ৫৩৯/১৬ দায়ের করেন। প্রাপ্ত ডকুমেন্ট পর্যালোচনায় বাদীনি প্রতিনিয়তভাবে প্রতারণা করার বিষয়টি প্রতীয়মান হয়।

বাদীর নারাজি এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদন:

তদন্ত প্রতিবেদনটি জমা দেওয়ার পর মামলার বাদী হোসনে আরা পারুল আদালতে নারাজী দেন। আদালত মামলাটি অধিকতর তদন্তের জন্য নগর গোয়েন্দা পুলিশকে দায়িত্ব দেন। মামলাটি অধিকতর তদন্ত করে নগর গোয়েন্দা পুলিশের এসআই রূপন কুমার দে আদালতে প্রতিবেদন জমা দেন।

প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, যেখানে আদালত চলাকালে শত শত লোকজন এবং সার্বক্ষণিক পুলিশ প্রহরারত থাকে এবং বাদিনীর তাৎক্ষণিকভাবে বিজ্ঞ আদালতে উপস্থিত হয়ে কোন আইনানুগ সহযোগিতা চাননি। উল্লেখিত স্থানে যদি কোন ঘটনা সংঘঠিত হতো তাহলে কোনো আসামি পলায়নের সুযোগ নেই। এছাড়া অত্র মামলার বাদীনিকে বারবার তাগিদ দেওয়ার পরও কোন সাক্ষী হাজির করে মামলার ঘটনা প্রমাণ করিতে পারেন নাই। মূলতঃ বাদিনীর সাথে বিবাদীদের পূর্বে কোন মামলাকে প্রভাবিত করার জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে বা বিবাদীদের হয়রানী করার উদ্দেশ্যে মনগড়া ঘটনার বর্ণনা করে অত্র মামলা দায়ের করেছেন মর্মে প্রতিয়মান হয়।

নগর গোয়েন্দা পুলিশ মামলাটি তদন্ত করতে গিয়ে আরো একটি তথ্য পান। মামলার বাদী হোসনে আরা পারুল এজহারে উল্লেখ করে রাকিবুল ইসলাম এবং শেখ শহিদ হোসেন তাকে ঢাকার রমনা হোটেলে নিয়ে কুপ্রস্তাব দেয়। এই তথ্যটি তদন্ত করতে গিয়ে নগর গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে ২০১৫ সালের ৭ এপ্রিল রমনা হোটেলের ৯০৫ নং রুমে ব্যবসায়িক কারণ উল্লেখ করে মো. রহমত উল্লাহ নামের এক ব্যক্তির সাথে অবস্থান করেন হোসেনে আরা পারুল। তাদের দুজনের ছবি এবং তথ্য হোটেল কর্তৃপক্ষের কম্পিউটারে রক্ষিত আছে। তারা দু’জন ৭ এপ্রিল থেকে ৯ এপ্রিল পর্যন্ত রমনা হোটেলের সেই কক্ষে অবস্থান করেন।

হোসনে আরা বেগমের দায়ের করা এই মামলার প্রধান আসামি শেখ শহীদ হোসেন বলেন, হোসনে আরা পারুল একজন প্রতারক এবং মামলাবাজ মহিলা। দীর্ঘদিন আদালতে উপস্থিত না হয়ে পালিয়ে ছিলেন। বর্তমানে প্রতারণার একটি মামলায় কারাগারে আছেন। আমাদের রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক এবং সামাজিক সুনাম নষ্ট করার জন্য সম্পূর্ণ অসৎ উদ্দেশ্যে মামলা দায়ের করে এখন নিজে ফেঁসে গেছেন। আমি আশা করছি  প্রশাসন বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে পারুল এবং তার সংঘবদ্ধ চক্রটিকে সবার সামনে এনে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি করতে সক্ষম হবে।

এদিকে, হোসনে আরা পারুল গত ১৩ মার্চ থেকে ব্যাংক থেকে অবৈধভাবে টাকা উত্তোলনের অভিযোগে দায়ের করা প্রতারণা মামলায় কারাগারে অবস্থান করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

-সিভয়েস/এসএ

মুহাম্মদ নাজমুল হাসান

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়