Cvoice24.com

ডিম ছাড়ার জন্য উপযোগী হালদা নদীর পানি, বাড়তে পারে ডিম সংগ্রহ— বলছে গবেষণা 

শারমিন রিমা

প্রকাশিত: ১২:৩৯, ১৮ এপ্রিল ২০২২
ডিম ছাড়ার জন্য উপযোগী হালদা নদীর পানি, বাড়তে পারে ডিম সংগ্রহ— বলছে গবেষণা 

এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন মাসের যেকোনো পূর্ণিমা ও অমাবস্যার কয়েক দিন আগে-পরে জোয়ার ও ভাটার সময়ে মা মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে। ডিম সংগ্রহের ফাইল ছবি।

দেশের কার্প জাতীয় মাছের অন্যতম  প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্র হালদা নদীতে ডিম ছাড়তে মা মাছ বজ্রপাত আর বৃষ্টির অপেক্ষায় থাকে। এপ্রিলের মাঝামাঝি থেকে জুন মাসের যেকোনো পূর্ণিমা ও অমাবস্যার কয়েক দিন আগে-পরে জোয়ার ও ভাটার সময়ে মা মাছ হালদা নদীতে ডিম ছাড়ে। কিন্তু প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে গতবছর হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল তলানিতে। তবে এ বছর ডিম সংগ্রহ বাড়ার আশা দেখছেন গবেষকরা। কারণ এবার নদীর পরিবেশ নিরাপদ অর্থাৎ ডিম ছাড়ার জন্য উপযোগী অবস্থায় রয়েছে হালদার পানি। বর্তমানে হালদার পানির গুরুত্বপূর্ণ ভৌত রাসায়নিক যে প্যারামিটারগুলো আছে তা আদর্শমানের ভেতরে রয়েছে। এ বছর নদী পরিবেশের ভিন্নতা ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় না ঘটলে ডিম সংগ্রহের পরিমাণ বাড়বে বলে আশা করছেন নদীর গবেষকরা।

যদিও গতবছরেও মা মাছ ডিম ছাড়ার জন্য নদীর পরিবেশ ভালো ছিল। কিন্তু তার পরেও ডিম সংগ্রহ ছিল নগন্য। এর কারণ হিসেবে গবেষকরা বলেছেন— দীর্ঘ সময় থেকে বজ্রসহ বৃষ্টিপাত বন্ধ থাকা এবং ঘূর্ণিঝড় ইয়াস পরবর্তীতে স্বাভাবিকের চেয়ে নদীর পানিতে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়াই ডিম কম পাওয়ার মূল কারণ ছিল। তবে এ বছর প্রজনন মৌসুমের শেষ পর্যন্ত নদী পরিবেশের স্থিতিশীলতা ও প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্যতা বজায় থাকলে হালদায় কার্পজাতীয় (রুই, কাতলা, মৃগেল, কালবাউশ) মা মাছের ডিম ছাড়ার নজির তৈরি হতে পারে বলে ধারণা গবেষকদের।

এদিকে, গত ১৬ এপ্রিল প্রাকৃতিক মৎস্য প্রজনন ক্ষেত্র-হালদা নদীর স্পনিং গ্রাউন্ডের পাঁচটি পয়েন্ট (অঙ্গুরীগোনা, নোয়াহাট, নাপিতেরঘাট, আজিমারঘাট ও রামদাসঘাট) থেকে পানির নমুনা সংগ্রহ করে নিজস্ব হালদা ল্যাবে পরীক্ষা করেন হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম।

গবেষণায় নদীর এ পাঁচটি পয়েন্টের পানির গড়মানে দেখা যায়— পানির তাপমাত্রা ২৯ দশমিক ৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস আছে যার আদর্শমান ২০ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। পানির স্বচ্ছতা ৩৫ সেন্টিমিটার আর এর আদর্শমান হলো ১৫ থেকে ৪০ সেন্টিমিটার। তড়িৎ পরিবাহিতা পাওয়া যায় ১২১ মাইক্রোসিমেন্স আর এর আদর্শমান ৩৫০ মাইক্রোসিমেন্স। টিডিএস পাওয়া যায় ৬০ পিপিএম, যার আদর্শমান ১ হাজার পিপিএম। যদি এ মাত্রা তারও বেশি হয় তবে তা জলজ প্রাণীদের জন্য হুমকিস্বরূপ। 

এছাড়াও হালদায় এ পাঁচটি পয়েন্টে পানির পিএইচ পাওয়া যায় ৭ দশমিক ৪ মাত্রায় আর এর আদর্শমান মাত্রা হলো ৬ দশমিক ৫ থেকে ৮ দশমিক ৫। দ্রবীভূত অক্সিজেনের মাত্রা পাওয়া যায় ৫ দশমিক ৯ মি.গ্রা./লি। আর এই মানের আদর্শ মাত্রা হলো ৫ মি.গ্রা./লি। কার্বন ডাই অক্সাইড পাওয়া যায় ৫ মি.গ্রা./লি যা পানিতে ১০ মি.গ্রা./লি পর্যন্ত পাওয়া গেলে আদর্শমান মাত্রায় আছে বলে ধরা হয়। পানিতে ক্যালসিয়াম ৯ দশমিক ৬ মি.গ্রা./লি মাত্রায় পাওয়া যায়, আর এই মাত্রার আদর্শমান ৩৬ মি.গ্রা./লি। পানির খরতা পাওয়া যায় ৪৫ মি.গ্রা./লি আর আদর্শমান মাত্রা হলো ২০০ থেকে ৫০০ মি.গ্রা./লি পর্যন্ত। পানিতে ক্ষারকত্ব ৩৫ মি.গ্রা./লি মাত্রায় পাওয়া যায়, যার আদর্শমান হলো ৫০০ মি.গ্রা./লি পর্যন্ত। অন্যদিকে, পানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্যারামিটার হচ্ছে লবণাক্ততার পরিমাণ, যা হালদা নদীতে শূন্য দশমিক শূন্য ৫ পিপিটির কম মাত্রায় পাওয়া যায়। এর আদর্শমান হলো শূন্য দশমিক ৫ পিপিটি।

এ বিষয়ে হালদা গবেষক ড. মো. শফিকুল ইসলাম সিভয়েসকে বলেন, `হালদা নদীর পাঁচটি পয়েন্টের পানি পরীক্ষা করার পর তুলনামুলক বিশ্লেষণে দেখা যায়, যে পানিতে থাকা সকল ভৌত-রাসায়নিক প্যারামিটারগুলোর মান আদর্শমানের মধ্যে রয়েছে যা হালদা নদীর বাস্তুতন্ত্রের মাছ ও অনান্য জলজ জীবের জন্য উপযোগী। পানির এই অবস্থা ও অনুকুল পরিবেশ বিদ্যমান থাকলে এই বছর ভালো ডিম পাওয়া যাবে বলে আশা করি।'

তিনি আরও বলেন, 'শুধু পানির এ প্যারামিটারগুলো অনূকূলে থাকলে হবে না, সেইসঙ্গে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত মানে আবহাওয়াও অনূকূলে থাকা লাগবে। যেমন গতবার বৃষ্টিপাত তেমন হয়নি যার প্রভাব কিন্তু পড়েছে। মানে যে বৃষ্টিপাত বা বৃষ্টির কারণে পাহাড়ি ঢ্ল হবে না তখন কিন্তু মা মাছ ডিম ছাড়ে না।'

অন্যদিকে, ২০২১ সালে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাড়ে ছয় হাজার কেজি। ২০২০ সালে ছিল ২৫ হাজার ৫৩৬ কেজি। এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে হালদায় ডিম সংগ্রহের পরিমাণ ছিল সাত হাজার কেজি। বৈশাখে শুরুতে বজ্রসহ বৃষ্টি তথা কালবৈশাখী হলেই নদীতে ডিম ছাড়বে কার্প জাতীয় মিঠা পানির মা মাছ। 

তবে, ২০২০ সালের হালদা নদীতে ডিম সংগ্রহের প্রকৃত তথ্য নিয়ে গরমিলের অভিযোগও পাওয়া যায়। কিন্তু সব মিলিয়ে জলবায়ুর পরিবর্তনে বা ঋতু পরিবর্তনসহ নানা কারণে হালদা নদীতে মা মাছের ডিম ছাড়ার স্থান কমে যাচ্ছে। গত বিশ বছরেও যেখানে প্রায় বার থেকে পনেরটি ডিম ছাড়ার স্থান ছিল তা বর্তমানে চার থেকে পাঁচটিতে এসে দাঁড়িয়েছে। আবার প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রতিনিয়ত ভাসান জাল কিংবা ঘেরা জাল বসিয়ে অহরহ মা মাছ নিধন করা হচ্ছে। যদিও প্রশাসন নিয়মিত অভিযান বা নজরদারিতে রাখছে। কিন্তু পরিবেশ অনূকুলে না থাকায় অনেক সময় মা মাছ ডিম না ছেড়ে তার পেটেই রেখে দেয় আর এতে দূরদূরান্ত থেকে ডিম ছাড়তে আসা মা মাছ বাধাগ্রস্থ হচ্ছে। তবে গতবারের মতো এ বছরেও নদীর পরিবেশ নিরাপদ অবস্থানে রয়েছে আর এ কারণে প্রচুর মা মাছের বিচরণ রয়েছে হালদায়।
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়