Cvoice24.com

সীতাকুণ্ডে গ্রাহকের কোটি টাকা আত্মসাত করলো ‘আল-আমানতের’ মাঠকর্মীরা

সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৮:৪৫, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২২
সীতাকুণ্ডে গ্রাহকের কোটি টাকা আত্মসাত করলো ‘আল-আমানতের’ মাঠকর্মীরা

সীতাকুণ্ডের ‘আল-আমানত সমবায় সমিতি’। যেখানে গরীবেরা তাদের কষ্টের উপার্জনের কিছু অংশ সঞ্চিত রাখে এবং প্রয়োজনে তার বিনিময়ে ঋণ গ্রহণ করে। কিন্তু সমিতির মূল প্রতিষ্ঠাতা মো. মুছা মিয়ার মৃত্যুর পর এর দখল চলে যায় মাঠকর্মীদের হাতে। এরপর থেকেই দেখা দেয় বিপত্তি। দুঃসময়ে সঞ্চিত অর্থ চেয়েও ফেরত পাচ্ছেন না গরীব গ্রাহকেরা। ফলে কষ্টের সঞ্চয় না পেয়ে হাহাকার করছেন তারা। ভুগছেন অনিশ্চয়তায় আদৌ সেই টাকা ফেরত পাবেন কিনা। এদিকে পাওনাদারের ভয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন মো. মুছা মিয়ার মৃত্যুর পর সমিতির উদ্যোক্তা ও সভাপতি ছেলে মোশারফ হোসেন। 

জানা যায়, ২০০০ সালে ‘পন্থিছিলা ইসলামিয়া দাখিল মাদ্রাসার’ শিক্ষক মো. মুছা মিয়া  ‘আল আমানত’ নামে একটি বহুমুখী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। ২০০৫ সালে কয়েক হাজার সদস্য নিয়ে উপজেলা সমবায় অধিদপ্তরের নিবন্ধনও পায় সমিতিটি।  সঞ্চয় ও ঋণদান ছাড়াও অন্যান্য ব্যবসায়িক কার্যক্রমের মাধ্যমে রমরমা হয়ে ওঠে প্রতিষ্ঠানটি। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। সমস্যা শুরু হয় সমিতির মূল পরিচালক মুছা মিয়ার মৃত্যুর পর। ২০১৭ সালে মুছা মিয়ার আকস্মিক মৃত্যুতে স্থবির হয়ে পড়ে সমিতির কার্যক্রম। 

স্বামীর মৃত্যুর পর সমিতির দায়িত্ব বুঝে নেন স্ত্রী রুবিনা ইয়াসমিন। কিন্তু মাঠকর্মীদের অসহযোগিতা ও পাওনাদারদের চাপে প্রচণ্ডভাবে ভেঙ্গে পরেন তিনি। এরই জেরে ২০২০ সালে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চলান রুবিনা। এরপর হাসপাতালের আইসিইউতে ১৫ দিন পর মৃত্যুবরণ করেন তিনি। এদিকে মা-বাবা দুইজনকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়ে ১০ম শ্রেণী ও ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া দুই ভাই। সেইসময়েই সমিতির পূর্ণ নিয়ন্ত্রন চলে যায় মাঠকর্মীদের হাতে। 

এরই সুযোগে কয়েকজন মাঠকর্মী প্রায় কোটি টাকার উপরে হাতিয়ে নেয়। রুবিনার মৃত্যুর পর আমানতকারীরা তার বড় ছেলে মোশারফ হোসেনকে টাকার জন্য চাপ দিতে থাকলে তিনি মাঠকর্মীদের কাছে হিসাব দেখতে চান। কিন্তু দুইজন হিসাব দিলেও পারভিন আক্তার, মোছাম্মদ রিমা ও রোকেয়া আক্তার নামে বাকি তিনজন কর্মী হিসাব দিতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে মোশারফ হোসেন উপজেলা সমবায় কর্মকর্তার শরণাপন্ন হন। 

উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সমিতির বিস্তারিত খোঁজখবর নিতে ও মাঠ কর্মীদের কাছ থেকে হিসাব নেওয়ার নির্দেশ দেন। এরপরই একে একে মাঠকর্মীদের টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রকাশ পায়। 

বর্তমান সমিতি মালিক মোশারফ হোসেন জানান, ‘আমার মায়ের মৃত্যুর সুযোগ নিয়ে মাঠকর্মীদের কয়েকজন গ্রাহকের প্রায় কোটি টাকার উপরে হাতিয়ে নিয়েছে। এছাড়াও আমানতকারীদের কোন রকম সেবা দিচ্ছিলেন না তারা। এজন্য পাওনাদারেরা সবাই আমাকেই ধরত। মায়ের মৃত্যুর সময় আমি ১০ম শ্রেনীর ছাত্র ছিলাম। সমিতির ব্যাপারে আমি তেমন কিছুই অবগত ছিলামনা। পাওনাদারদের চাপ সহ্য করতে না পেরে কয়েকবার আত্মহত্যার চিন্তাও এসেছিল মাথায়। উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা ও নির্বাহী কর্মকর্তা আশ্বস্ত না করলে এতদিনে কিছু একটা ঘটে যেত। ২০২০ সালে এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার পরে পাওনাদারদের চাপাচাপির কারণে পড়ালেখাও বন্ধ হয়ে যায় আমার।’

মোশারফ হোসেন আরও বলেন, ‘মাঠকর্মী পারভিন আক্তারের কাছে সমিতির পাওনা আছে ৫০ লাখ টাকারও অধিক। তার কাছে বারবার হিসাব চাইলেও নানা কথা বলে তিনি হিসাব দিতে অস্বীকৃতি জানান। অপর দুই মাঠকর্মী মোছাম্মদ রিমা ও রোকেয়া আক্তার ২০ লাখ করে ৪০ লাখেরও অধিক টাকা আত্মসাত করেছে।’

তিনি বলেন, পারভিন আক্তার প্রথমে কান্নাকাটি করে আমাকে বাবা ডেকে তার কাছে টাকা পাওনার কথা না জানাতে অনুরোধ করেন। কিন্তু আমি সমবায় কর্মকর্তার কাছে পাওনার ব্যাপারে জানিয়ে দিই। সমবায় কর্মকর্তার সামনে পাওনার ব্যাপারে স্বীকারও করেন তিনি। এর কয়েকদিন পর স্বামীকে নিয়ে আমার বাসায় এসে আমাকে ধমক দিয়ে বলেনম, ‘বড়দের সাথে বেয়াদবি কর কেন? তোমার মা-বাবা আমাকে সম্মান করে কথা বলত। বেশি বাড়াবাড়ি করলে পরিণাম ভালো হবেনা। তোমার মা-বাবা কখনো আমার কাছে হিসাব চায়নি, তুমি কে হিসাব চাওয়ার ?’ ইত্যাদি কথা বলে যায়।

অভিযুক্ত মাঠকর্মী পারভিন আক্তারকে এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ফোন করা হলে তিনি তাচ্ছিল্যের সুরে বলেন, ‘আমি ৫০ লাখ টাকা মেরে দিয়েছি। জায়গা কিনেছি, বাড়ি করেছি। সমিতির এমডি আমাকে জিজ্ঞেস করার সাহস করেনা। আপনি কে জিজ্ঞেস করার? আমার স্বামী আপনার সাথে এ বিষয়ে কথা বলবে।’

কোথায় কথা বলবে জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন।

অপর অভিযুক্ত মাঠকর্মী রোকেয়া আক্তারকে ফোন দিলে তার স্বামী সেলিম উল্লাহ ফোন ধরে বলেন, ‘হিসাবে যদি আমাদের কাছে টাকা পাওনা থাকে আমরা দিয়ে দিব।’

মোবাইল ফোন বন্ধ থাকাতে আরেক অভিযুক্ত রিমার সাথে কথা বলা সম্ভব হয়নি। 

উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা শহীদ উদ্দিন ভূইঁয়া বলেন, ‘উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নির্দেশনা অনুযায়ী সমিতির আয়-ব্যয়ের হিসাব-নিকাশের কাজ চলছে। আরও কিছু হিসাব বাকি রয়েছে। এর মধ্যে আমরা সমিতির দেনা পাঁচ কোটি টাকা ও পাওনা প্রায় ২ কোটি টাকার হিসাব পেয়েছি। এছাড়া কিছু টাকা ব্যাংকে জমা আছে। মৃত মুছা মিয়ার নামে কিছু সম্পদের খোঁজ পাওয়া গেছে সেসব বিক্রি করে গ্রাহকের টাকা সমন্বয়ের চেষ্টা করা হবে। আরব বাংলাদেশ ব্যাংকে সমিতির নামে ৭৪ লাখ টাকা ছিল। তা ইতিমধ্যে আমরা গ্রাহকদের মাঝে বিতরণ করেছি।

নির্বাহী কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘সমিতির দেনা পাওনা হিসাব করা হচ্ছে। মৃত মুছা মিয়া গ্রাহকের টাকা সমিতির নামে ব্যাংকে না রেখে তার মৃত স্ত্রীর নামের অ্যাকাউন্টে রাখেন। তার স্ত্রীও মারা যাওয়াতে টাকাগুলো পেতে আদালতের আদেশ প্রয়োজন। এ নিয়ে প্রসেসিং প্রায় শেষ পর্যায়ে। এদিক থেকে যা টাকা পাওয়া যাবে আনুপাতিক হারে পাওনাদারদের মধ্যে তা বিতরণ করা হবে। এছাড়া মাঠকর্মীসহ যাদের কাছে টাকা পাওনা রয়েছে তা আদায়ের জন্য ইতিমধ্যে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়