করোনাভাইরাস কেন এত অপ্রতিরোধ্য?
করোনা মহামারি পৃথিবীটাকেই দুম করে বদলে দিয়েছে। এত দ্রুততায় এটি ছড়িয়েছে যে মুহূর্তেই পৃথিবীটা থমকে গেছে। যেন একটু অসাবধান হলেই মৃত্যুর বন্যা নেমে আসবে পৃথিবীতে! যদিও এ পৃথিবী জন্মলগ্ন থেকেই মহামারি দেখেছে, মৃত্যু দেখেছে। কিন্তু ‘করোনাভাইরাস’একটু আলাদাই। এর অন্যতম বৈশিষ্ট্য অত্যন্ত দ্রুত ছড়িয়ে পড়া আর বারবার নিজের সক্ষমতাকে বদলে ফেলা। এক অদ্ভূত শক্তিতে এটি ঘুরছে এক মানুষের কোষ থেকে অনেক মানুষের কোষে কোষে।
পৃথিবীর বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা বলেছেন, করোনাভাইরাস খুব দ্রুত ছড়াতে পারে। ‘ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজ’ জার্নাল পড়ে এটুকু বুঝে নিয়েছি এটি সংক্রমণ ক্ষমতা কতোটা তীক্ষ্ণ।আমেরিকা ও চীনে ভাইরাসটির সিরিয়াল ইন্টারভাল গণনা হয়েছে। আমরা জেনেছি ভাইরাসটি নিজেকে ৪৮০ বার পরিবর্তন করেছে। বারেবারে করোনা হয়ে উঠেছে অপ্রতিরোধ্য। এ বিষয়টি কয়েকটি জার্নাল ও সংবাদমাধ্যমে ইতিমধ্যে ছাপাও হয়েছে।
করোনাকে জানতে আমাদের দুটি বিষয় জানা প্রয়োজন
এক-ইমার্জিং ইনফেকশাস ডিজিজ কি?
দুই- সিরিয়াল ইন্টারভাল কি?
ইমার্জিং ডিজিজ বা হঠাৎ উৎপন্ন হওয়া অসুখ। এটি ছোঁয়াচে নাও হতে পারে। এটি হলো যখন কোনো একটি রোগের প্রাদুর্ভাব হঠাৎ বেড়ে যায় সেটিই ইমার্জিং ডিজিজ। ওই ইমার্জিং ডিজিজটি যদি ইনফেকশাস বা সংক্রামক হয় তবে রোগটি একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে। এই একজন আক্রান্ত ব্যক্তি থেকে অন্যজন আক্রান্ত হওয়া এবং রোগের লক্ষণ প্রকাশ না পাওয়া পর্যন্ত সময়টিকে বলা হয় সিরিয়াল ইন্টারভাল। যেমন সিনেমায় একটি একটি এক মিনিট বা দুমিনিটের ইন্টারভাল থাকে ব্যপারটা তেমনই।
করোনায় চীনে গড়ে এই সিরিয়াল ইন্টারভাল সময় ছিলো ৪দিন। অর্থাৎ একজন আক্রান্ত মানুষ থেকে অন্যজন আক্রান্ত হতে এবং লক্ষণ প্রকাশ করতে ৪দিন সময় লেগেছে। ওই ৪দিনে কোন লক্ষণ ছাড়াই রোগটি ছড়িয়েছে এক থেকে অন্যজনে। আরেকটি বিষয় বলতে হয়। করোনা নতুন কোন ভাইরাস না। এটি আগেও ছিল। মার্স করোনা এবং সার্স করোনা রুপে। কিন্তু তাদের সাথে এই করোনার পার্থক্য কি?
এই করোনা আমাদের কাছে অপরিচিত। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানে অপরিচিত রোগের আগে ‘নভেল’ যুক্ত করা হয়। এই করোনাভাইরাস খুব দ্রুতই নিজের ধরন বদলে নিতে পারে। খুব দ্রুত ছড়ায়, সিরিয়াল ইন্টারভাল সময়টি খুব কম। দ্রুত ছড়ানোর কারণেই এ রোগ অনেক বড় ত্রাসের সৃষ্টি করেছে।
এখন কোনো একটি মহামারি (এপিডেমিক) কত দ্রুত ছড়াবে তা মূলত দুই বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। একজন আক্রান্ত থেকে কজনে এটি ছড়াতে পারে এবং ছড়াতে কতটুকু সময় লাগে। করোনায় সিরিয়াল ইন্টারভাল আশংকাজনকভাবে কম। করোনার প্রজনন সংখ্যা বেশি। তাই করোনাভাইরাস এমন দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে।
এর আগে আফ্রিকায় ইবোলার প্রকোপ দেখা দেয়। কিন্তু এটার সিরিয়াল ইন্টারভাল কয়েক সপ্তাহ হওয়ায় এটা বিশ্বব্যাপী ছড়ানোর আগেই তা দমন করা সম্ভব হয়েছিল।
ইবোলায় এ রোগী শনাক্ত করা এবং আলাদা করার জন্য অনেক বেশি সময় পাওয়া গিয়েছিল। অন্যান্য ফ্লুয়ের তুলনায়। করোনা যেহেতু ফ্লুর মতো তাই আমাদের দ্রুতই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
চীনের ৯৩ শহরে ৪৫০ জন আক্রান্ত ব্যক্তির পরীক্ষায় দেখা যায়, লক্ষণ প্রকাশের আগেই আক্রান্তরা ভাইরাস ছড়িয়েছে। সেখানে প্রতি ১০ জনে একজন ভাইরাসটিকে বহন করছিলেন কোন রকম অসুস্থতা বা লক্ষণ ছাড়াই। যদিও এই লক্ষণবিহীন সংক্রমণের ব্যাপারে বিজ্ঞানীরা প্রথমদিকে বেশ দ্বিধায় ছিলেন।
তাহলে কীভাবে করোনা দমন হবে?
এ রোগ নিয়ন্ত্রণে আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন, স্কুল বন্ধ, ভ্রমণ নিষিদ্ধকরণ, জনসমাবেশ নিষিদ্ধকরণটাই মৌলিক ব্যবস্থা। কারণ লক্ষণ ছাড়া সংক্রমণ এই রোগকে নিয়ন্ত্রণ করাকে আরো কঠিন আরও অপ্রতিরোধ্য করে তোলে।
আমাদের বুঝতে হবে ভাইরাসটি উড়তে পারে না। এটি ছড়াবে কাশি, শ্বাস প্রশ্বাস, স্পর্শ বা মিলনের মাধ্যমে।
সুতরাং কেউ হাঁচি-কাশি দিলে এর ৬ ফুটের মধ্যে না থাকলে ভাইরাস আক্রমণ করার সুযোগ পাবে না। তবে ওই ৬ ফুটে যা কিছু আছে সব কিছুতে ভাইরাসটি আটকে থাকবে। সুতরাং পরবর্তীতে কারো স্পর্শের মাধ্যমেও জীবাণু হাতে আসতে পারে।
কীভাবে সাবধান হবেন?
আমাদের মনে রাখতে হবে ‘রুল অফ T’ দুই চোখ নাক মুখ বরাবর একটা T কল্পনা করেন। এই T বরাবর হাত দেওয়া যাবে না।
আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইন মানতে হবে। কারণ দূরত্ব মানেই করোনাকে প্রজনন করতে না দেওয়া। কারণ কোষ ছাড়া এটি বংশবৃদ্ধি করতে পারে না।
পরিচ্ছন্নতা মেনে চলা আরেকটি ভালো উপায়। এর মাধ্যমে ভাইরাসতো মরবেই। অন্যান্য ক্ষতিকর ব্যকেটেরিয়ারাও বাঁচতে পারবে না।
শেষে বলতে হয় প্লেগ, স্প্যানিশ ফ্লুসহ অসংখ্য মহামারিকে মানুষ কালের পরিক্রমায় জয় করেছে। কিন্তু ততদিনে শোধ করা করা হয়েছে চড়া মূল্য। করোনা যেন আমাদের ওই ক্ষতি করতে না পারে সেজন্য সবার নিজ নিজ জায়গা থেকে সাবধান হওয়া উচিত।
ঢাকা মেডিকেল কলেজের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী
সাদমান মুহতাসিম