Cvoice24.com

মোহাম্মদ নূরুজ্জামানের অবসর ভাবনা ‘নেশা’

মোহাম্মদ নূরুজ্জামান

প্রকাশিত: ২২:৩৭, ২ মে ২০২১
মোহাম্মদ নূরুজ্জামানের অবসর ভাবনা ‘নেশা’

মোহাম্মদ নূরুজ্জামান

বাহিরবাড়ির গোয়ালঘরে মজুররা যখন দলবেঁধে তামাক খেতো, কৌতূহলভরে তা উপভোগ করতাম। কী দারুণ ব্যাপার! হুঁকোয় ঠোঁট লাগিয়ে ছন্দে ছন্দে বাতাস টানে, গড়গড় শব্দ হয়। কলকে-তে তামাকটা পুড়তে পুড়তে মাঝে মাঝে ফোঁস করে জ্বলে উঠে। মুখের দু’পাশ দিয়ে ভসভস করে বের হয় সুবাসিত ধোঁয়া। 

একদিন সুযোগ বুঝে আমরা কয়েকজন কিশোর নিপুণ অভিজ্ঞতায় হুঁকো সাজিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করলাম— কে কতো বেশি ধোঁয়া বের করতে পারে। এক একজন প্রাণপণে ধোঁয়া টানে, খুকখুক কাশি, অন্যদের সে কী হাসি। কিন্তু ‘পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে’। আমার বাবা অসাধারণ শ্রবণশক্তির টানে গোয়ালঘরে উপস্থিত। তারপর, দরজা বন্ধ করে এক একজনকে একহাতে কান টেনে আর এক হাতে থাপ্পড়ের তবলবাজি শুরু করেন আর মুখ খিঁচিয়ে বলেন— বেয়াদবের দল, নেশা করা শিখে গেছস?

শিখতে আর পারলাম কই? প্রশিক্ষণ পর্বটি আতুরঘরেই বেঘোরে মারা পড়লো। কৌতুহলী নেশার ভূত তাড়ানোর কবিরাজি ঔষধ আমাদের মতো সকলের কপালে জুটেনা। অনুকূল পরিবেশ পেয়ে কেউ কেউ দিনে দিনে পরিপক্ক হতে থাকে। একসময় মাটি ছেড়ে আকাশে উড়ে স্বপ্নীল মাদকের ময়ূরপঙ্খি নাও! নিচে মুখথুবড়ে পড়ে থাকে পরিবার-সমাজের কাঁচা স্বপ্নগুলি।

‘যত দোষ ঐ নন্দঘোষে’র বেটা মাদকের। কিন্তু বিচিত্র লেবাসে বুক চেতিয়ে ঘুরে যে বেড়ায় নেশার গুরুজনরা, তা কি দেখা সহজ? ধন-দৌলত আর ক্ষমতা- প্রতিপত্তির নেশায় যে মজেছে, তার আরো চাই, আরো চাই। ধর্ম, নৈতিকতা ও মানবতাকে নিলামে তুলে মহারাজ হতে চায়। কিন্তু, কী নির্মম পরিহাস! মাংস খেলে প্রেশার বাড়ে, মিষ্টি খেলে সুগার লেবেল অস্থির, শীতাতপে শ্বাসকষ্ট। আর মরে গেলে সরকারি শেষকৃত্যস্থানে স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন শেষ ভরসা।

তারচেয়ে যদি একটু অন্যরকম নেশা হতো— মানুষের পাশে মানুষ হয়ে দাঁড়ানোর নেশা, তাহলে অন্তত মৃত্যুর পর কেউ চোখের জল ফেলতো। অনেকেই অনেক কিছু করছে। অসহায়ের দিকে একটু হাত বাড়িয়ে দেয়া, অভুক্ত মানুষটি মুখে একটু খাবার তুলে দেয়া। এই নেশা চরম নেশা— মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর নেশা। এমন নেশা কেন সবার হয়না?

মোফাজ্জল করিমের ‘নেশা’ কবিতাটি পড়ছিলাম। গ্রাম্যপিতা শহুরে ছেলের বাসায় অসময়ে উপস্থিত। কাপড় ময়লা, পায়ে পথের ধুলোবালি। আধুনিকা স্ত্রী ও শিক্ষিত বন্ধুদের সামনে ছেলে বিব্রত ও মহাবিরক্ত। পিতা চলে যাওয়ার পর ক্ষুব্ধ ছেলে ভর্ৎসনা স্বরে বাবাকে চিঠি লিখে— ‌কি দরকার যখন তখন আসার। টাকা লাগলে পাঠিয়ে দিতাম। আর এত টাকা লাগেই বা কেন? তোমাদের তো আর অন্য কোন নেশা নেই, শুধু চিরতা আর ইসবগুল খাওয়া ছাড়া। তারপর—

‘এইটুকু পড়িয়া দরিদ্র স্কুলমাস্টার 
পিতা আনমনে বলিয়া উঠিলেনঃ
না না, ভুল বললিরে বাবা,
নেশা একটা আছে, বড় পুরানো সেই নেশা
কিছুতেই ছাড়িতে পারিনা সেই নেশা।
তোর জন্মের পর থেকে সারাক্ষণ তোকে দেখার নেশা,
কিছুতেই ছাড়িতে পারিনা বাপ, কিছুতেই ছাড়িতে পারিনা।’
কবিতাটি পড়া শেষ করতেই একটা প্রশ্ন মনে উঁকি দিল— বাবাদের-ই কি শুধু এমন নেশা হয়? সন্তানদের হয়না?

(চট্টগ্রাম, ২৫ এপ্রিল, ২০২১)

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়