জমি দাতারাই আজ লালদিয়াতে বাস্তুহারা

শুভ্রজিৎ বড়ুয়া

প্রকাশিত: ২০:৫১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২১
জমি দাতারাই আজ লালদিয়াতে বাস্তুহারা

উচ্ছেদে ঠিকানা হারাবে ৪৯ বছরের বসতি গড়া ১৭শ’ পরিবার

উচ্চ আদালতের আদেশের কথা বলে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ লালদিয়া চরের মানুষকে উচ্ছেদের চূড়ান্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। অথচ উচ্ছেদের কবলে পড়া বাসিন্দারাই ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু সরকারের অনুরোধে চট্টগ্রামের বিমান বাহিনীর ঘাঁটি স্থাপন করতে নিজেদের জমি দিয়ে এসেছিলেন। এখন নিজের বাপ-দাদার বিটা ফেলে বাস্তুহারা হতে হচ্ছে লালদিয়া চরের বাসিন্দাদের। এ অবস্থায় উচ্ছেদের বিষয়ে নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী অনঢ় অবস্থানের কথা জানালেও আন্দোলনকারীসহ চট্টগ্রামের সরকার দলীয় নেতাদের অনেকেই চাচ্ছেন ক্ষতিগ্রস্থদের ‘অবৈধ’ বলে হুট করেই উচ্ছেদ না করে তাদের পুর্নবাসন করা হোক আগে।  

ইতোমধ্যে ১৭শ’ পরিবারের দশ হাজার লোকের বসতি উচ্ছেদের লাল মাইকিং করেছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ। বিচ্ছিন্ন করে দেয়া হয় তাদের বৈদ্যুতিক সংযোগ। ফলে বাস্তু হারানোর ভয়ের সাথে বিদ্যুৎ ও পানির অভাবে নিদারুণ কষ্টে পড়েছে এ চরের জনগণ। এমনকি বাপ-দাদার ভিটা হারানোর দুঃশ্চিন্তায় কয়েকজন স্ট্রোক করেছেন এবং একজন মৃত্যুবরণ করেছে বলে জানায় স্থানীয়রা। অথচ যারা বর্তমানে লালদিয়া চরে বসতি স্থাপন করেছেন, তারা বিমান বাহিনীর জহুরুল হক ঘাঁটিতে তাদের নিষ্কন্টক জায়গা ছেড়ে ১৯৭২ সালে সরকারি নির্দেশে এ চরে এসেছিলেন।

সরেজমিনে লালদিয়া চর এলাকার বসতি পরিদর্শনে জানা যায়, এ এলাকায় বসতি স্থাপন করা লোকজন ও তাদের পরিবার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির। এলাকায় ১টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৩টি কিন্ডার গার্টেন স্কুল, ২টি মাদ্রাসা ও ১টি মসজিদ আছে। প্রায় দশ হাজার লোকের বসতি রয়েছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের আবেদনের প্রেক্ষিতে লালদিয়ার চর এলাকার স্থাপনাসমূহকে অবৈধ ঘোষণা করে চট্টগ্রামের উচ্চ আদালত। এই প্রেক্ষিতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়। বিদ্যুৎ না থাকায় তাদের পানি তোলার মোটর চলছে না। ফলে পানি ও বিদ্যুতের অভাবে মানবেতর জীবন-যাপন করছেন লালদিয়া চরের বাসিন্দারা।

এই এলাকার একজন বাসিন্দা মো. গফুর মিয়া সিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা যুদ্ধের পরপর আমাদের নিষ্কন্টক জায়গা ছেড়ে এ চরে এসেছি। আমাদের জায়গার খাজনা আমরা বাংলা বছরের ১৩৮০-১৩৮১ সাল পর্যন্ত পরিশোধ করেই জহুরুল হক বিমানঘাঁটি এলাকা ছেড়ে এসেছি। তখনকার সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমাদের হালিশহরের বিহারি এলাকা ও লালদিয়া চর থেকে যেকোনো একটি জায়গা নির্বাচন করে থাকতে বলেছিলো। আমরা পার্শবর্তী এলাকা হিসেবে লালদিয়া চর এলাকাটি বেছে নেই। কিন্তু এখন আমরা চরম দুর্ভোগে পড়েছি। বিদ্যুৎ নেই, পানি নেই, দুইদিন পর আমাদের উচ্ছেদ করবে। কি করবো বুঝতে পারছি না!’

নিষ্কন্টক জায়গা ছেড়ে সরকারি পরামর্শে লালদিয়া চরে এলেও বন্দর কর্তৃপক্ষ কেন উচ্ছেদ করতে চায় জানতে চাইলে লালদিয়া চর পুনর্বাসন কমিটির সভাপতি আলমগীর হাসান সিভয়েস বলেন, ‘আমরা ১৯৭২ সালে লালদিয়া চরে আসলেও ১৯৭৩ থেকে আমাদের স্যাটেলমেন্ট নিয়ে সমস্যা হয়। কারণ এ জায়গায় আবুল কাশেম ও আবুল হাশেম নামের দুই ভাইয়ের একটি খামার ছিলো। তাই ওরা জায়গাটি নিষেধাজ্ঞা জারি করে দেয়। তবে আমাদের একটা সৌভাগ্য যে, বঙ্গবন্ধু আমাদের স্থায়ীকরণের জন্য একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে দেন।’

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, লালদিয়া চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে ১৪ জন শিক্ষক ও ৩৩০ জন শিক্ষার্থী আছে। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এ উচ্ছেদ অভিযান ঘোষণা দেয়া সহ লাল মাইকিং করলেও এ বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য কোনো নির্দেশনা আসেনি। 

এ বিষয়ে বিদ্যালয়টির প্রধান শিক্ষিকা বুবলি বিশ্বাস বলেন, ‘এ উচ্ছেদের বিষয়ে আমরা শুনেছি। উচ্ছেদ করা হলে ওখানকার বসতিদের খুব কষ্ট হবে। আর এতোগুলো মানুষ একসাথে কোথাও থাকার বন্দোবস্ত করাও কঠিন হবে। তবে এ উচ্ছেদ অভিযান পরিচালিত হলে স্কুলটার কি হবে তাও জানি না। তবে এ উচ্ছেদ সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা শিক্ষা অফিস থেকে আমাদের কাছে আসেনি।’

এ নিয়ে লালদিয়া চরের বাসিন্দা সুফিয়ান আলম বলেন, ‘বছরের পর বছর বিদ্যুৎ বিল দিয়ে আসছি। এখন বন্দরের একটি কু-চক্র মহলের প্রস্তাবে আমাদের বাসস্থানকে অবৈধ ঘোষণা করে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ১০ হাজার মানুষ এলাকায় অবস্থান করা অবস্থায় কিছু অতি উৎসাহী বন্দর কর্মকর্তার নির্দেশনায় সম্পূর্ণ অন্যায় ও অমানবিকভাবে লালদিয়ার চর এলাকার পানি ও বিদ্যুৎ এর সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে ১০ হাজার মানুষকে অন্ধকার আর পানির কষ্ট দিয়ে মানবাধিকার লঙ্গন করেছে।’

এদিকে উচ্চ আদালতের নির্দেশে কর্ণফুলী নদীর তীরে লালদিয়ার চরে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ স্থাপনা উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলে আন্দোলনে নামে লালদিয়ার চরের বাসিন্দারা। তারা উচ্ছেদ পূর্বক পুনর্বাসনের দাবিতে মানববন্ধন সহ পালন করেছে নানা কর্মসূচি। তাদের দাবি-দাওয়া ও কর্মসূচীর সাথে একাত্ম ঘোষণা করেছে চট্টগ্রামের রাজনৈতিক মহল ও বিভিন্ন সামজিক সংগঠনের ব্যক্তিবর্গ।

আন্দোলনরত লালদিয়াচর বাসিরা জানায়, ১৯৭২ সালে বিমান ঘাঁটি সম্প্রসারণের সময় স্থায়ী বন্দোবস্তি পাওয়ার আশ্বাসের ভিত্তিতে নিজেদের ভিটামাটি ছেড়ে লালদিয়ার চরে বসতি শুরু করে স্থানীয় কয়েকশ পরিবার। এখন ওই এলাকায় ১৭শ’ পরিবারের ১০ হাজার মানুষের বসবাস। এটা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের সিদ্ধান্ত। আজকে এত বছর পর যখন আমরা মুজিব শতবর্ষ পালন করছি ঠিক এই সময় বঙ্গবন্ধুর সিদ্ধান্তকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে একটি ষড়যন্ত্রকারি মহল আমাদের এখান থেকে কোন রকম পুর্নবাসনের সিদ্ধান্ত না নিয়েই এই এলাকার ১০ হাজার মানুষকে উচ্ছেদের অমানবিক ও অন্যায় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে।

এদিকে গত বুধবার নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী লালদিয়া চরে পুনর্বাসন করার মতোও কেউ নেই উল্লেখ্য করে সাংবাদিকদের বলেন, লালদিয়া চরে জমি দখলে রেখে যারা আর্থিক ফায়দা লুটেছে তাদের তালিকা করা হয়েছে এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া কোনো স্বচ্ছল পরিবারকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা সরকারের নেই।

তবে মন্ত্রীর এমন মন্তব্যের তীব্র নিন্দা জানান লালদিয়া চরের বাসিন্দারা। তারা বলেন, ১০ হাজার মানুষের ভোগান্তির কথা মন্ত্রী হয়ে তিনি কিভাবে উপেক্ষা করেছেন এটা খুবই আশ্চর্যের বিষয়। এদিকে আন্দোলনের অংশ হিসেবে লালদিয়া চরবাসী গত শুক্রবার (২৬ ফেব্রুয়ারী) সকাল ১১টায় চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবের সামনে মানববন্ধন ও বেলা ১১টায় সাংবাদিক সম্মেলন করে।

এদিকে শনিবার (২৭ ফেব্রুয়ারি) এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে চসিকের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেছেন, ‘আমরা চট্টগ্রামবাসী বন্দর কর্তৃপক্ষের এ ধরনের কাজের তীব্র নিন্দা জ্ঞাপন করছি। আমরা পরিষ্কারভাবে বলে দিতে চাই, উচ্ছেদ করতে গিয়ে যদি কোন রক্তক্ষয় কিংবা কোন মানুষের জীবনহানি হয় তার পরিপূর্ণ দায়দায়িত্ব চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে। সেজন্য বন্দর কর্তৃপক্ষ অনুশোচনারও সুযোগ পাবে না। বন্দরের অভ্যন্তরে বসে কারা এসব কাজে উস্কানি দিচ্ছে তার তালিকাও চট্টগ্রামবাসীর কাছে আছে।’

ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী মুজিববর্ষে এভাবে উচ্ছেদ না করার আহ্বান জানান তিনি। খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী এবং মুজিববর্ষ উপলক্ষে সারাদেশে গৃহহীনদের মাঝে ঘর তৈরি করে দিচ্ছেন, আশ্রয় দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রীর এ কর্মকাণ্ড যখন বিশ্বব্যাপী সমাদৃত ঠিক তখনই চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে লুকিয়ে থাকা বিএনপি জামাতচক্র প্রধানমন্ত্রীর এ কর্মকাণ্ডকে ধুলিস্যাৎ করে দিতে চায়। তারা চায় প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন কর্মকাণ্ডকে প্রশ্নবিদ্ধ করে বিএনপি জামাতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করার জন্য।’ 

বন্দর কর্তৃপক্ষের উচ্ছেদ অভিযানে কোন প্রকার সহযোগিতা না করার জন্য আইনশৃংখলা বাহিনীসহ সংশ্লিষ্ট সকলের নিকটও অনুরোধ জানান তিনি।

এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সহকারী ব্যবস্থাপক (ভূমি) শিহাব উদ্দিন সিভয়েসকে বলেন, ‘আমরা গত কিছুদিন আগে উচ্ছেদ করার কথা ছিলো। কিন্তু পুলিশের অনুরোধে সময় পিছিয়েছি। আগামী ১ মার্চ উচ্ছেদ করার বিষয়ে আমরা সবার সাথে কথা বলছি। বন্দরের উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের কাজে লালদিয়া চর এলাকাটি ব্যবহৃত হবে। এছাড়া আদালতের আদেশও আছে।’

-সিভয়েস/এমএম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়