Cvoice24.com

বলীখেলা নয়, হতে পারে শুধু বৈশাখী মেলা!

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৯:০৬, ১৪ এপ্রিল ২০২২
বলীখেলা নয়, হতে পারে শুধু বৈশাখী মেলা!

লালদীঘির মাঠে তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলা। ফাইল ছবি।

শত বছর ধরে লালদীঘির মাঠে যে ঐতিহাসিক জব্বারের বলীখেলা হয়ে আসছিল গত দুই বছর করোনার অজুহাতে তা বন্ধ রাখা হয়েছিল। করোনার কালো মেঘ চট্টগ্রামের আকাশ থেকে সরে গেলেও এবার মেলা ও খেলার জন্য আপদ হয়ে দাঁড়িয়েছে লালদীঘির মাঠ। ঐতিহাসিক ছয় দফাসহ বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্যের নানা সাক্ষী লালদীঘির মাঠটিতে ২ কোটি ২৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ঐতিহাসিক ছয় দফা মঞ্চ, বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার ম্যুরাল স্থাপন, কিডস কর্ণার, ঘাস লাগানো, সীমানা প্রাচীর, ফটক নির্মাণের প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর।

লালদীঘির মাঠটি এখনো উন্মুক্ত না হওয়ায় তিন দিনব্যাপী ঐতিহাসিক বৈশাখী মেলা ও জব্বারের বলীখেলা তৃতীয়বারের মতো না হওয়ার বিষয়টি সংবাদ সম্মেলন করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেয় আয়োজক কমিটি। যদিও আগের দিন ১২ এপ্রিল রাতে ‘লালদীঘিতে জব্বারের বলীখেলা এবারও হচ্ছে না’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল সিভয়েস।

এ সংবাদ প্রকাশের পর চট্টগ্রামের সব শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। কথাটি যায় চট্টগ্রামের মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর কানেও। বুধবার রাতে একটি টেলিভিশনের অনুষ্ঠানে মেয়র এলে সেখানে উপস্থিত কয়েকজন সাংবাদিক তাকে বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানান। তখন মেয়র জানান, তিনি বিষয়টি নিয়ে মেলা কমিটির চেয়ারম্যান ও স্থানীয় কাউন্সিলর জহরলাল হাজারীর সঙ্গে কথা বলবেন। যে কোন মূল্যে মেলা করার বিষয়ে পদক্ষেপ নিবেন।

এরই ধারাবাহিকতায় মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর বাসায় বৃহস্পতিবার রাতে ডাক পড়েছে জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা কমিটির। কমিটির সেক্রেটারি ও আব্দুল জব্বার সওদাগরের নাতি শওকত আনোয়ার বাদলকে বিশেষভাবে ডেকে পাঠিয়েছেন মেয়র। বলীখেলা না হলেও অন্তত তিন দিনব্যাপী বৈশাখী মেলাটি যাতে করা যায় সেই উদ্যোগই নেওয়ার বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে আজকের বৈঠক থেকে।

বিষয়টি নিশ্চিত করে জব্বারের বলীখেলা ও বৈশাখী মেলা কমিটির সভাপতি, স্থানীয় আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী সিভয়েসকে বলেন, ‘মাঠ এখনো উদ্বোধন হয়নি; তাই আমরা কালকে মেলা-খেলা দুটাই না করার কথা সংবাদ সম্মেলন করে জানিয়েছিলাম। তবে আজকে মেয়র মহোদয় তার বাসায় আব্দুল জব্বারের পরিবার ও মেলা কমিটিকে তার বাসায় আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। রাতে মেয়রের বাসার বৈঠকেই সিদ্ধান্ত হবে মেলার আয়োজন করা হবে কিনা।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘মাঠের কারণে হয়তো বলীখেলা হবে না। তাছাড়া স্পন্সরসহ নানা প্রস্তুতি নিতে হয়। তবে মেলার বিষয়টির সাথে পুলিশ প্রশাসন জড়িত। সেটার জন্য শুধু ঘোষণাটাই যথেষ্ট আর পুলিশের রোডম্যাপসহ সহযোগিতা। তাই অন্তত দুই বছর পর হলেও মেলাটা আমরা করতে চাই। আশা করি মেয়র মহোদয় সেই সিদ্ধান্তই দিবেন।’  

এর আগে, বুধবার রাতে ইটিভির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীকে বৈশাখী মেলা ও বলীখেলা আয়োজনের বিষয়টি তুলে ধরেন টেলিভিশনটির উপ-বার্তা সম্পাদক হাসান ফেরদৌস। একথা জানিয়ে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘ইটিভির  প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অনুষ্ঠানে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী এলে আমরা কথার ফাঁকে ঐতিহ্যবাহী লালদীঘির বৈশাখী মেলা ও জব্বারের বলীখেলা না হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরে তাকে উদ্যোগ নেওয়ার অনুরোধ জানাই। এসময় তিনি স্থানীয় কাউন্সিলর ও মেলা কমিটির সঙ্গে কথা বলে মেলা ও খেলা আয়োজনের উদ্যোগ নেবেন বলে আমাদের আশ্বস্ত করেন। লালদীঘির মাঠ এখনও উন্মুক্ত না হওয়ায় মেয়রকে পলোগ্রাউন্ড মাঠ, আউটার স্টেডিয়াম মাঠ ও সিআরবির শিরীষতলার কথা তুলে ধরি। যাতে মেলা ও বলীখেলা আয়োজন করা যায়।’

যদিও বুধবার রাতে মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মোবাইলে অসংখ্যবার কল করলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরবর্তীতে মেয়রের এপিএস দুলালকে কল করে বিষয়টি জানানো হলে তিনি সরাসরি মেয়রের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। পরে বৃহস্পতিবার বিকেলে মেয়রকে কল দিলেও যথারীতি তিনি রিসিভ করেননি। ফলে মেয়রের কাছ থেকে বলীখেলা ও বৈশাখী মেলার বিষয়ে কোন বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।

এর আগে, গত ১৩ এপ্রিল চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের এস রহমান হলে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে মেলা কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মুহাম্মদ জামাল হোসেন বলেন, ‘১৯০৯ সালের ১২ বৈশাখ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত বলীখেলা ও মেলার ১১০তম আসর নিয়মিত হয়েছে। কোভিড–১৯ ভয়াবহতায় ২০২০ ও ২০২১ সালে এটি স্থগিত ছিল। বঙ্গবন্ধু কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্বে সরকার এই মহামারী প্রতিরোধে গণটিকা প্রদানসহ নানা কর্মসূচির কারণে বর্তমানে দেশ ও জাতি অনেকটা নিরাপদে। দেশে ইতোমধ্যে অনেক মেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বিগত ১১০ বছর ধরে এই বলীখেলা লালদীঘির মাঠেই অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে। ঐতিহাসিক এই মাঠ শত শত বছর ধরে অনেক ঘটে যাওয়া ইতিহাসের সাক্ষী। তার স্মৃতি ধরে রাখতে সরকার মাঠের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রশংসার দাবিদার। বর্তমানে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা মাঠটি উন্মুক্ত নয়। এজন্য বাঙালি সংস্কৃতির অংশ হিসেবে পরিচিত আবদুল জব্বারের বলীখেলা ও মেলাসহ চট্টগ্রামের সকল ধরনের অনুষ্ঠান পুনরায় ফিরে পেতে লালদীঘির মাঠ দ্রুত উন্মুক্ত করে দেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে আকুল আবেদন জানাচ্ছি।’

এরপর বলীখেলা ও মেলা না হওয়ার ঘোষণা দেন কমিটির সভাপতি ও আন্দরকিল্লা ওয়ার্ডের কাউন্সিলর জহরলাল হাজারী। তিনি বলেন, ‘জব্বারের বলীখেলা আমরা সাংবাদিকদের মাধ্যমে সারাদেশে উপস্থাপন করতে পেরেছি। এই মেলা কখন হবে— সেটি নিয়ে তাই সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে বসে থাকেন। গত দুই বছর মেলা হয়নি। এবছর আমরা আশা করেছিলাম। আমরা চাই মাননীয় শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী লালদীঘির মাঠ সংরক্ষণে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, সেটির উদ্বোধন প্রধানমন্ত্রী করুক। এখন পর্যন্ত উদ্বোধন না হওয়ায় মাঠটি উন্মুক্ত নয়। মাঠ না পাওয়ার কারণে এই বছর বলীখেলা আয়োজন করা যাচ্ছে না। একইসঙ্গে এবার মেলাও হবে না।’

এরপর পরই শুরু হয় প্রতিক্রিয়া। বুধবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের সাবেক প্রশাসক খোরশেদ আলম সুজন বলেন, ‘বলীখেলা বাঙালির প্রাণের উৎসব। যুগ যুগ ধরে বলীখেলা উপলক্ষে মেলা চলে এসেছে তার নিজস্ব স্বকীয়তায়। বলীখেলার এ মেলাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ অর্থনীতি চাঙ্গা হতো। চট্টগ্রাম শহরসহ আশপাশের জেলার অধিবাসীরাও সারাবছর ধরে অপেক্ষা করে থাকেন এ মেলার জন্য। এই মেলা ও বলীখেলাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে।’

চট্টগ্রাম জেলা শিল্পকলা একাডেমির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাবু ফেসবুকে লিখেছেন, ‘বলীখেলা ও মেলা হতে পারবে না— কারা সিদ্ধান্ত দিচ্ছে, তাদের নামগুলো প্রকাশ করা দরকার। এটি আমার বাংলার চিরায়িত লোক ঐতিহ্য। আমার সংস্কৃতি চর্চা বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে কেন, বুঝতে পারছি না। আমরা সংস্কৃতিকর্মীরা এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি। বৈশাখ মাসে জব্বারের বলীখেলা ও মেলা হবে, তার অপেক্ষায় থাকি সারা বছর। আজ বলছে হবে না— এই কথা শুনতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।’

চট্টগ্রাম প্রেস ক্লাবের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক আলীউর রহমান লিখেছেন, ‘লালদীঘি মাঠে ছয় দফা মঞ্চ করতে কয় বছর লাগে? জব্বারের বলীখেলা না হওয়ার জবাবদিহি আপনাদের করতেই হবে।’

সাংবাদিক আল রহমান লিখেছেন, ‘জব্বারের বলীখেলা দিনে না হলে রাতে হোক। লালদীঘির মাঠে না হলে পলোগ্রাউন্ড, আউটার স্টেডিয়াম, ফিরিঙ্গিবাজার নদীর পাড়, বাকলিয়া চরে হোক।’

ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে যুবকদের উদ্বুদ্ধ করতে ১৯০৯ সালে চট্টগ্রামের বকশিরহাটের ব্যবসায়ী আবদুল জব্বার সওদাগর চালু করেছিলেন বলীখেলা। এরপর ২০১৯ সাল পর্যন্ত প্রতি ১২ বৈশাখ লালদীঘি ময়দানে অনুষ্ঠিত হতো জব্বারের বলীখেলা। এই বলীখেলাকে কেন্দ্র করে লালদীঘির আশপাশের প্রায় তিন কিলোমিটার এলাকাজুড়ে বসত বৈশাখী মেলা।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়