বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণ/
মামলা করেই দায় সারলো পুলিশ, পাঁচ দিনেও গ্রেপ্তার নেই

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:০৮, ১৩ জুন ২০২২
মামলা করেই দায় সারলো পুলিশ, পাঁচ দিনেও গ্রেপ্তার নেই

সীতাকুণ্ডের বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাসহ এখন পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন ৪৯ জন। আহত হয়েছেন অন্তত দুই শতাধিক। এ ঘটনায় দেশ-বিদেশে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হলেও চার দিনের মাথায় মালিক পক্ষকে পাশ কাটিয়ে ডিপোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা করে পুলিশ। যদিও পুলিশের করা মামলার আট আসামির সবাই বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়েছেন। সমালোচনা থেকে বাঁচতে পুলিশ ‘প্রশ্নবিদ্ধ’ মামলা করলেও মামলা দায়েরের পাঁচ দিন পার হলেও এখনো আসামিদের কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। মূলত সমালোচনা থেকে বাঁচতে পুলিশ মামলা করলেও আহত কর্মকর্তাদের আসামি করলেও তাদের গ্রেপ্তারেও সমালোচনার ভয়ে আসামিদের অবস্থান জেনেও পুলিশ গ্রেপ্তারের পথ হাটছে না। 

তবে পুলিশ বলছে, মামলার আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এমনকি আসামিরা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে গণমাধ্যমকে বক্তব্য দিয়ে চললেও পুলিশ নাকি তাদের বিষয়ে কোন খোঁজই পাচ্ছে না। 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফ ছিদ্দিকী বাদী হয়ে গত মঙ্গলবার রাতে মামলাটি করেন। মামলার আসামিরা হলেন—  বিএম কনটেইনার ডিপোর উপমহাব্যবস্থাপক (অপারেশন) নুরুল আক্তার, ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমান, সহকারী প্রশাসনিক কর্মকর্তা আব্বাস উল্লাহ, জ্যেষ্ঠ নির্বাহী (প্রশাসন) নাছির উদ্দিন, সহকারী ব্যবস্থাপক আবদুল আজিজ,ডিপোর শেডের ইনচার্জ সাইফুল ইসলাম, সহকারী ডিপো ইনচার্জ নজরুল ইসলাম ও মহাব্যবস্থাপক নাজমুল আক্তার খান। মামলার এজাহারে আসামিদের বিরুদ্ধে দায়িত্ব পালনের অবহেলার কারণে মানুষের মৃত্যু হয়েছে বলে অভিযোগ করা হয়েছে। 

এদিকে ডিপোর কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলা হওয়ায় এসব পরিবারের স্বজনেরা উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে দিন পার করছে।

পুলিশের করা মামলার এক নম্বর আসামি নুরুল আক্তার নগরের বেসরকারি মেট্টোপলিটন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। অগ্নিকাণ্ডে নুরুলের বাম হাত থেকে মাংস খসে পড়ে এবং তিনি পায়ে গুরুতর আহত হন। উন্নত চিকিৎসার জন্য নুরুল আক্তারকে আজ ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।  

নুরুল আক্তারের সেজো ছেলে ইয়াছির আনোয়ার সিভয়েসকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে আব্বুর বেশ কিছু সার্জারি করা হয়েছে, পায়ের সার্জারি এখনও বাকি আছে। উনার কেটে যাওয়ার পায়ের অংশে ইনফেকশন না হওয়ার জন্য শরীরের বিভিন্ন স্থান থেকে মাংস নিয়ে সার্জারি করে বসানো হবে। চিকিৎসকরা বলছেন তিনি সুস্থ আছেন। তবে কোনো ভাবেই যেনো জ্বর না আসে, সে বিষয়ে খেয়াল রাখতে বলছে। জ্বর আসলে তার অবস্থা খারাপের দিকে যেতে পারে।’ 
 
মামলা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘এই মামলাটি উনার নামে করা ঠিক হয়নি। ঘটনায় ভুক্তভোগীর বিরুদ্ধে কীভাবে মামলা করা হয়? কোথা থেকে, কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে সেটি তদন্ত করে দোষীদের আসামি হোক। ঘটনাটি কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যেতো এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। উল্টো অবহেলার কথা বলে আব্বুকে আসামি করা হয়েছে। এত বড় একটি ঘটনার পর পরিবারের সবাই শারীরিক ও মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছি। এমন অমানবিক ঘটনা কীভাবে আমাদের সঙ্গে করা হলো।’

আগুন নেভাতে গিয়ে মামলার দুই নম্বর আসামি ডিপোর ব্যবস্থাপক (প্রশাসন) খালেদুর রহমানের শরীরের ১২ শতাংশ পুড়ে গেছে। তিনি ঢাকার শেখ হাসিনা বার্ন ইনস্টিটিটিউটে ভর্তি আছে। তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে।

তার মেয়ের জামাই নজরুল ইসলাম বাবু চিকিৎসকের বরাত দিয়ে সিভয়েসকে বলেন, ‘তিনি এখনও শঙ্কামুক্ত নন। চিকিৎসকরা বলছেন এসব রোগী যে কোনো মুহূর্তে ফল ডাউন করতে পারে। উনারা পর্যবেক্ষণে রেখেছেন। এখনও কিছু বলা যাচ্ছে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিষয়টি পুরোটাই অমানবিক। তিনি বাসায় ছিলেন। উনি ঘটনাস্থলে না গেলেও পারতেন। তবুও প্রতিষ্ঠানের স্বার্থে তিনি কাজ করতে ছুটে গিয়েছেন। জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণের সময় মামলার সংবাদটা আসলো। সবাই মানসিকভাব বিপর্যস্ত। উনার শরীর ও মামলা নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। আমি নিজেও পেশায় একজন আইনজীবী। এখনই যেহেতু মামলা হয়ে গেছে। উনি সুস্থ হয়ে উঠার পর আমরা আইনীভাবে ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।’

এছাড়াও মামলা অন্য আসামিরা আহত হয়ে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন বলে জানা গেছে।

মালিকপক্ষকে আড়াল করতেই পুলিশ যোগসাজেশে বেআইনীভাবে মামলাটি করেছেন বলে দাবি করেছেন চট্টগ্রাম বারের আইনজীবী রেজাউল করিম রনি। 

তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘যদি কোনো কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দায়ভার, গাফিলতি থাকে সেই বিষয়টি প্রতিষ্ঠানের মালিক কিংবা কর্ণধারের উপর পড়ে। এক্ষেত্রে মালিক পক্ষ কোনোভাবেই বিষয়টি এড়াতে পারে না। প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতি রক্ষা করতে গিয়ে যারা এগিয়ে এসেছেন তাদের আসামি করাটা অত্যন্ত অমানবিক, অনৈতিক ও বেআইনি। দেশের সংবিধান ও আইন অনুযাী এটি কোনো ভাবেই কাম্য নয়। ভুক্তভোগীরা কখনও আসামি হতে পারে না। উনারা ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ায় এসব মামলায় সাক্ষী হতে পারতেন। উল্টো মালিকপক্ষকে বাঁচানোর জন্য পুলিশ যোগসাজেশে এদের মামলার আসামি করেছেন।’

এদিকে পুলিশের করা মামলাটি তদন্ত করছেন সীতাকুণ্ড থানার পরিদর্শক (তদন্ত) সুমন বণিক। জানতে চাইলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি। আসামিরা কোথায় ভর্তি আছেন, চিকিৎসাধীন আছেন এই মুহূর্তে আমি বলতে পারছি না। আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি। বিভিন্ন সূত্র থেকেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছি।’ 

মামলার এক ও দুই নম্বর আসামির চিকিৎসার বিষয়টি তুলে ধরার পর পুলিশের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো চিকিৎসকের কাগজপত্র আমাদের কাছে আসেনি। আমাদের তদন্ত চলছে। তদন্ত শেষে আমরা ব্যবস্থা নিতে পারব।’

২০১১ সালে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুই কোম্পানির যৌথ বিনিয়োগে বেসরকারি ইনল্যান্ড কনটেইনার ডিপোটি গড়ে তোলা হয়। এর মালিকনায় রয়েছে দেশের শীর্ষ শিল্প প্রতিষ্ঠানর স্মার্ট গ্রুপ। ডিপোটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক হলেন স্মার্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান মো. মুজিবুর রহমান। তিনি চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করছেন। অথচ ঘটনার পর থেকেই তিনি নিশ্চুপ।

বিস্ফোরণের পর ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ডিপোতে হাইড্রোজেন পার অক্সাইড থাকলেও বিষয়টি জানানো হয়নি। যার কারণে পানি দিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে গিয়ে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তাসহ এত প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এমনকি অভিযানের বেশ কয়েক ঘণ্টা মালিকদের কাউকে পাওয়া যায়নি বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। এরপরও মামলায় মালিক পক্ষকে আড়াল করা হয়েছে।  

সিভয়েস/আরকে

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়