হাইড্রোজেন পারক্সাইড ছিল বিএম ডিপোতে, ১৬ কনটেইনার রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে!

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ০৩:৫৫, ৬ জুন ২০২২
হাইড্রোজেন পারক্সাইড ছিল বিএম ডিপোতে, ১৬ কনটেইনার রপ্তানি হওয়ার কথা ছিল পাকিস্তানে!

সীতাকুণ্ডের সোনাইছড়ির বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের পেছনে 'হাইড্রোজেন পারক্সাইড' নামক দাহ্য রাসায়নিকের মজুদকে দোষলেও গত ২৪ ঘণ্টায়ও তার কোন সঠিক তথ্য প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিসকে জানায়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। তবে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ বলছে— বিএম ডিপোর একই মালিকের আরেক প্রতিষ্ঠান আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্সই ৩৩টি কনটেইনারে করে দাহ্য কেমিক্যাল 'হাইড্রোজেন পারক্সাইড' ডিপোতে মজুদ করেছিল। সেখান থেকে ১৬টি কনটেইনার কয়েক দিনের মধ্যেই পাকিস্তানে রপ্তানি হবার কথা ছিল। 

অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের পর থেকে ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা বলে আসছেন— আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে তারা প্রথাগতভাবে পানি দিয়ে নেভানোর চেষ্টা করেছেন, কারণ ডিপোতে যে হাইড্রোজেন পারক্সাইড ছিল, সেটা ডিপোর কেউ ফায়ার সার্ভিস কর্মকর্তাদের জানায়নি। রাসায়নিক থাকার কথা জানতে পারলে তারা হয়ত অন্যভাবে কাজ করতেন। আরও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়ে ফোম ব্যবহার করে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করা হতো। তাছাড়া তাদের ৯ কর্মীকেও জীবন দিতে হতো না। 

যদিও স্মার্ট গ্রুপের জিএম (এডমিন) অবসরপ্রাপ্ত মেজর শামসুল হায়দার সিদ্দিকী রোববার বিকেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন 'হাইড্রোজেন পারক্সাইড' থাকার কথা তিনি জানেন না। বলেছেন, ‘আমিও এই মাত্র ঢাকা থেকে এসেছি। আমারও প্রশ্ন এটাই হবে। আপনি জানেন এখনকার সময়ে কেউ কোনো তথ্য গোপন রাখতে পারেন না। তদন্ত করে দেখি তারপর বাকিটা বলা যাবে।’ 

অন্যদিকে বিস্ফোরক অধিদপ্তর ও পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা ন্টেইনার ডিপোতে রাসায়নিক দ্রব্য থাকার বিষয়ে কিছুই জানেন না। বিস্ফোরক পরিদপ্তর চট্টগ্রামের পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন  বলেছেন— ‘কন্টেইনার ডিপোতে বিপদজনক পণ্য বা রাসায়নিক রাখার কোনো অপশনই নেই। সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর কিংবা প্রক্রিয়া অনুসরণ করার আগে এসব বাইরে রাখতে হয়। এসবের কিছুই কাস্টমস কর্তৃপক্ষ করেনি। তাহলে ধরে নেওয়া হবে এখানে অন্য কোনো বিপদজনক পণ্য আনা হয়েছে যা কাস্টমস রেজিস্ট্রারই করে নাই। এমনকি এই বিষয়টাতেও আমাদের জানানো হয়নি।’

একই প্রসঙ্গে পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের পরিচালক মুফিদুল আলম সিভয়েসকে বলেন, ‘এই রাসায়নিক দ্রব্যের অনুমতি কিংবা এ ব্যাপারে কিছুই জানায়নি ডিপো কর্তৃপক্ষ। আমরা জানিনাও সেখানে রাসায়নিক দ্রব্য মজুদ ছিল।’

পরিবেশ, বিস্ফোরক ও কনটেইনার ডিপো কেউই 'হাইড্রোজেন পারক্সাইড' নামক দাহ্য রাসায়নিক মজুদের বিষয়টি না জানলেও ঘটনাস্থলে শত শত প্লাস্টিক ড্রামে এ দাহ্য পদার্থটির দেখা মিলেছে। তাছাড়া ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারাও বিষয়টি নিশ্চিত হয়েছে 'হাইড্রোজেন পারক্সাইড' থাকার কারণেই মূলত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হচ্ছে না। 

তবে রোববার চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কমিশনার ফখরুল আলম অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বিস্ফোরণের কারণ অনুসন্ধানে পাঁচ সদস্যের কমিটি গঠনের কথা জানান। তিনি বলেন, ‘বিএম ডিপোতে আগুন লাগার ঘটনা কিভাবে ঘটলো তা তদন্ত করার জন্য বন্দর, কাস্টমস ও ফায়ার সার্ভিসের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। সেখানে কাস্টমসের একজন সিনিয়র ডেপুটি কমিশনারকে সদস্য হিসেবে রাখা হয়েছে। তদন্ত প্রতিবেদনটি হাতে পাই, তারপর আমরা যথাযথ আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারব।’

রোববার বন্দর চেয়ারম্যান চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহান ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘এই ডিপোতে সব রপ্তানি পণ্য রয়েছে। আমাদের দেশ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কেমিক্যাল রপ্তানি হয়। এখানে ডিপোর মুখে ২৬টি কেমিক্যাল ভর্তি কনটেইনার ছিল। সেখান থেকেই আগুনের সূত্রপাত বলে জানতে পেরেছি। ডিপোর ভেতরে ট্রেইলারগুলা সারিবদ্ধভাবে এখনো আছে। সেগুলো আগে সরানোর ব্যবস্থা করতে হবে।’ 

যদিও কাস্টমস হাউজের অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ শফিউদ্দিন বলেছেন, ‘আল রাজি কেমিক্যাল কমপ্লেক্স লিমিটেড নামের একটি কোম্পানি ৩৩ কনটেইনার হাইড্রোজেন পারক্সাইড রপ্তানির জন্য অনুমোদন নিয়েছে। বাকিটা তদন্তে বেরিয়ে আসবে।’ 

বিএম ডিপো থেকে অন্তত ১৬টি কনটেইনারভর্তি হাইড্রোজেন পারক্সাইড কেমিক্যাল কয়েক দিনের মধ্যে পাকিস্তানে রপ্তানি হতো বলে কাস্টমসের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন। 

চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে বিএম কনটেইনার ডিপোটির যৌথ মালিকানায় রয়েছে চট্টগ্রামভিত্তিক স্মার্ট গ্রুপ। তাদেরেই আরেক প্রতিষ্ঠান হাইড্রোজেন পারক্সাইড রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান আল রাজী কেমিক্যাল কমপ্লেক্স। ২০১১ সালে বাংলাদেশ ও নেদারল্যান্ডসের দুটি প্রতিষ্ঠানের ১৫০ কোটি টাকা বিনিয়োগে চালু হয় বিএম ডিপোটি। 

এদিকে রোববার ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি ও এরিয়া কমান্ডার মেজর জেনারেল মো. সাইফুল আবেদীন আশা প্রকাশ করেছিলেন ওই দিন রাত ১০টার মধ্যে আগুন পুরো নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। অথচ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েই চলেছে আগুনের তীব্রতা। আর এ কারণে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হচ্ছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের। তবে এ আগুন নিয়ন্ত্রণে না হলে অবশিষ্ট রাসায়নিকের কন্টেইনার থেকে যেকোনো মূহুর্তে আবারও বিস্ফোরণের আশংকা প্রকাশ করেছেন ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ। তবে এখনো পর্যন্ত কেউ জানে না হঠাৎ হঠাৎ লেলিহান শিখা নিয়ে জেগে উঠা এই আগুনের শেষ কোথায়? 

৫ জুন বিকেলের দিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় পরিস্থিতি কিছুটা সময়ের জন্য নিয়ন্ত্রণে থাকলেও সন্ধ্যা ৬টার দিকে আবারও আগুনের তীব্রতা বেড়ে যায়। পরবর্তীতে আধাঘণ্টার চেষ্টায় আগুন কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসে। তবে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আগুনের তীব্রতাও বেড়ে যায়। কালো ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে যায় পুরো এলাকা।

আগুন নিয়ন্ত্রণে না আসা প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিসের উপ পরিচালক (অপারেশন এন্ড মেইন্টেন্যান্স) মো দুলাল মিয়া বলেন, 'এখানে এখনো একটা নীল রঙের রাসায়নিক কন্টেইনার আছে যার কারণে কোনোভাবে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছেনা। কী পরিমাণ রাসায়নিক আছে তা না জানার কারণে আরও বেগ পেতে হচ্ছে।'

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, 'আগে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে। এরপর খুঁজে বের করতে পারবো এখানে কী পরিমাণ রাসায়নিক ছিল। অথবা কাদের অবহেলায় এতো বড় ঘটনা ঘটেছে। এছাড়া সব তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনের ভিত্তিতে যারা দোষী হবে তাদের সকলের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।'

অন্যদিকে, বিএম কনটেইনার ডিপোতে কী পরিমাণ রাসায়নিকের কন্টেইনার মজুদ ছিল তা এখনো পর্যন্ত জানাতে পারেনি মালিকপক্ষ। যদিও তাদের দাবি, কন্টেইনারে থাকা পণ্যের বেশিরভাগই গার্মেন্টস পণ্য। রপ্তানির জন্য এসব পণ্য ডিপোতে আনা হয়েছিল। 

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে যেসব পণ্য রপ্তানি হয় তা প্রথমে বেসরকারি কন্টেইনার ডিপোতে প্রথমে আনা হয়। সেখানে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে রপ্তানি পণ্য জাহাজে ওঠাতে সরাসরি নিয়ে যাওয়া হয় চট্টগ্রাম বন্দরে। 

শনিবার (৪ জুন) রাত ৮টার দিকে বিএম কন্টেইনার ডিপোর লোডিং পয়েন্টের ভেতরে আগুনের সূত্রপাত হয়। কুমিরা ফায়ার সার্ভিসের তিনটি ইউনিটের সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে প্রথমে আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে এক কন্টেইনার থেকে অন্য কন্টেইনারে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। কন্টেইনারে রাসায়নিক থাকায় একটি বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ, স্থানীয় শ্রমিকসহ অনেকে হতাহত হন। নিহত হয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ৯ জন কর্মীসহ ৪৫ জন। এখনো নিখোঁজ রয়েছেন ফায়ার সার্ভিসের ৫ কর্মী।

সম্পর্কিত বিষয়:

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়