অতিথি পাখি ও পর্যটক পদচারণায় মুখরিত বাঁশখালী ইকোপার্ক
একেক ঋতুতে একেক রূপে বাঁশখালী ইকোপার্ক!

প্রকাশিত: ০৫:২৮, ৫ জানুয়ারি ২০২০
একেক ঋতুতে একেক রূপে বাঁশখালী ইকোপার্ক!

ছবি : সিভয়েস

বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ - ঐতিহ্য সংবলিত ও পর্যটক আকর্ষণ করার মতো বহু নিদর্শন রয়েছে। তবে হাতে গুনা কয়েকটি উপজেলার মধ্যে চট্টগ্রামের বাঁঁশখালী অন্যতম। প্রিয়জনের হাতে হাত রেখে পর্যটনপ্রেমীরা প্রিয় মুহূর্তগুলো একান্তে পার করছে বাঁশখালী ইকোপার্কে। তরুণ-তরুণী, আবাল বৃদ্ধা বণিতা সকলের একমাত্র বিনোদনের স্পটে রূপ নিয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম পর্যটন স্পট বাঁশখালী ইকোপার্ক।

হৃদয় নিংড়ানো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি সড়ক, চারপাশে ঘন সবুজের সমারোহ, বন্যহাতির বিচরণ, চেনা-অচেনা পাখির মন-মাতানো কিচিরমিচির শব্দ, শীতের অতিথি পাখির বিচরণ, দেশের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু, সুউচ্চ টাওয়ার, অজস্র মন কাড়া বিনোদনের বিপুল সমাহার, মনোহারিণী বামের ও ডানের ছড়া লেকের ঝর্ণা কী নেই এখানে।

বহুমুখী আরণ্যক সৌন্দর্য ও নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী বাঁশখালী ইকো-পার্ক পর্যটকদের কাছে টানে। বাংলাদেশের একমাত্র দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুটিই এখানে অবস্থিত। স্বচ্ছ জলরাশি, শরতের কাশফুলের দৃশ্য ও বন্যপ্রাণীর হাঁকডাক, ঝাঁকে ঝাঁকে আসা শীতের অতিথি পাখির কলরব আর প্রকৃতি সেখানে এক অন্যরকম মায়ার অনুভূতি তৈরি করে এখানে। একেক ঋতুতে একেক রকম রূপ এই ইকোপার্কের। সারি সারি পাহাড় চূড়ায় নানা প্রজাতির বৃক্ষের সমাহার গ্রাম্যবধূর মতোই শান্ত রূপ নিয়ে যেন ঠায় দাঁড়িয়ে আছে উঁচু-নিচু পাহাড় গুলো। সুউচ্চ পাহাড়ের শীর্ষে ওঠে অনায়াসে দুরবীন ছাড়া খালি চোখেই দেখা যায় অদূরে বঙ্গোপসাগরের অথৈই জলরাশি। বিকালে উপভোগ করা যায় সূর্যাস্তের নয়নাভিরাম দৃশ্য। মনের রাজ্যে নিজেকে হারিয়ে নেওয়ার এক অপূর্ব সমন্বয় বাঁশখালী ইকো-পার্ক।

কুতুবদিয়া, মহেশখালী ও বাঁশখালী চ্যানেল নিয়ে সংযোজিত মোহনায় সামুদ্রিক জলের নানা বর্ণিল দৃশ্য সহজেই উপভোগ করা যায় সু-উচ্চ টাওয়ারের চূড়া থেকে। এখানে বিনোদনপ্রেমীদের ভিড় লেগেছে দেখারমতো। দূর দেশ থেকে আগত অতিথি পাখিদের কলকাকলি এবং বিনোদনপ্রেমীদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে এ ইকোপার্ক। দূর-দূরান্ত থেকে পর্যটকরা বাঁশখালী ইকোপার্কে এসে ভিড় জমাচ্ছেন। একদিকে গান-বাজনা অন্যদিকে অতিথি পাখির কলতান সব মিলিয়ে বাঁশখালী ইকোপার্ক বেশ জমে উঠেছে বিনোদনপ্রেমীদের পদচারণায়।

বাঁশখালী ইকো-পার্কে রয়েছে পিকনিক সেট, দ্বিতল রেস্ট কর্নার, দেশের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতু, সাসপেনশন ব্রিজ, দোলনা, স্কিপার, দ্বিতল রেস্ট হাউস, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর ব্যারাক ৪ ইউনিট, গেট, প্রধান ফটক, পাখি ও বন্যপ্রাণী অবলোকন টাওয়ার, লেক, কংক্রিটে শাবের ছাতা, রিফ্রেশমেন্ট কর্নার, ফেনোরোমিক ভিউ টাওয়ারসহ নানা বিনোদনের ক্ষেত্র।

প্রধান সড়ক থেকে ৪ কিলোমিটার পূর্বে পাহাড়ি এলাকায় প্রবেশমুখে আগন্তুকদের স্বাগত জানায় প্রধান ফটক বা গেট। ইকোপার্কে প্রবেশ করতেই চোখে পড়বে সবুজ পাহাড়ের হ্রদের পানির সঙ্গে নীল আকাশের লুকোচুরি খেলা, পাখির কোলাহল, ডাহুকের কিচিরমিচির ডাক, হ্রদের পানিতে স্পিডবোট ও ইঞ্জিনচালিত বোট নিয়ে হ্রদে ভ্রমণ অদূরে হারিয়ে যাওয়া। পর্যটকদের পিকনিক স্পট, রাত যাপনের জন্য কটেজ। যেন শ্রেষ্ঠ বিনোদনের একমাত্র নন্দিত আয়োজন, প্রকৃতির কোন এক রাজার রাণী।

২০০৩-০৪ অর্থবছরে বাঁশখালীর চুনতি অভয়ারণ্যে সহস্রাধিক হেক্টর বনভূমি নিয়ে এই পার্কটির কার্যক্রম শুরু হয়। পার্কটি এক সময় বামের ছড়া ও ডানের ছড়া নামে পরিচিতি লাভ করলেও ২০০৪ সালের পর থেকে বাঁশখালী ইকোপার্ক নামে পরিচিতি লাভ করে। এখানে দেশের দীর্ঘতম ঝুলন্ত সেতুর অবস্থান। এছাড়াও সুউচ্চ টাওয়ারের মাধ্যমে সূর্যাস্ত দেখার অপরূপ সৌন্দর্য ভ্রমণ পিপাসুদের আকৃষ্ট করে। চুনতি অভয়ারন্যে এক সময় ৪৫ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী, ৮৫ প্রজাতির পাখি, ২৫ প্রজাতির সরীসৃপ ও ৭ প্রজাতির উভচর প্রাণীর অবস্থান থাকলেও কালক্রমে বনের উপর জনচাপ সৃষ্টি হওয়ায় তা অনেকটা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে বাঁশখালী ইকো পার্ক। জরাজীর্ণ স্থাপনাগুলোর সংস্কার জরুরী হয়ে পড়েছে। তবে পার্কের বিভিন্ন স্থাপনা  সংস্কার করা গেলে দৃশ্যমান এক রুপ নিত।

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম থেকে ৬০ কিঃ মিঃ দক্ষিণে-পশ্চিমে বাঁঁশখালী পৌরসভার জঙ্গল জলদী ও শীলকূপ দুই ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থানে  অবস্থিত জলদী বন বিটের আওতাধীন  বামের ছড়া ও  ডানের ছড়া সংস্কার কার্যক্রম  আধুনিকায়নের মাধ্যমে ২০০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামে তথা পুরো বাংলাদেশের  আলোকিত পর্যটন স্পট হিসেবে রূপ নেয়। এরপর নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, বিভিন্ন ধরনের জীবজন্তুর সমাহার, দেশের দীর্ঘতম সর্ববৃহৎ ৪০০ ফুট দীর্ঘ ঝুলন্ত সেতু, অসংখ্য কৃত্রিম লেক, নয়নাভিরাম কটেজ, ও সুউচ্চ টাওয়ার,রয়েছে ছোট ছোট পাহাড় আরই মাঝে প্রবাহমান আঁকাবাঁকা ঝর্ণাধারা  সবমিলিয়ে অল্পদিনেই সারাদেশে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে বাঁশখালী ইকোপার্ক ।

পর্যটন উপজেলায় রূপান্তরিত হওয়ার পর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মন্ডিত উপজেলা। এখানে পশ্চিমে রয়েছে ২৫ কি.মি সমুদ্রসৈকত। আছে সাড়ে চার'শ একর জায়গার পাহাড়ি ভূমিতে নান্দনিক চা-বাগান, যা সাত'শ একরে উন্নিত হতে পারবে।  উপজেলার মূল সড়কের পূর্ব পাশে ৩৩ কি.মি সবুজ পাহাড়। এখানে চা-বাগান ছাড়াও রয়েছে বন বিভাগের বেশ কটি রেস্টহাউজ।  শিলকুপ ইউনিয়নের বামের ছড়া ও ডানের ছড়ায় বন বিভাগের উদ্যোগে শূন্যদশকে প্রতিষ্টিত হয় বাঁশখালী ইকো পার্ক। শঙ্খনদী,চাঁদপুরের চর,  উপজেলার মাঝখানে বয়ে যাওয়া ২২ কি. মি দৈর্ঘ্য জলকদর খাল।

ইকো পার্কের গেইটর ইজারাদার জাকের হোসেন বলেন, শীতের মৌসুমে  নানা ধরনের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে পর্যটকদের সুবিধার্থে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করা হয়েছে। পর্যটকরা প্রবেশের আগেই সহজ যাতায়তে বিনোদন প্রেমিদের উন্মুক্ত পক্ষিশালা বাঁশখালী ইকোপার্ক। ৫’শ ২০ একর জায়গা জুড়ে গড়ে ওঠা এই বিনোদন কেন্দ্রের বিভিন্ন ষ্পটে রয়েছে দেশি ও বিদেশি পাখি, কৃত্রিম লেক, শিশুদের জন্য দোলনা, পাখি দেখার জন্য উন্মুক্ত গ্যালারি, মিনি চিড়িয়াখানা, জলাধারের উপর ব্রীজ, কৃত্রিম গুহা, ভ্রমণের জন্য উচু নিচু পাহাড়,পযর্টকরা বসার জন্য রয়েছে বিভিন্ন ধরনের বড় বড় ছাতি। পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে ঘুরে সবুজ প্রকৃতি একসাথে উপভোগ করার জন্য রয়েছে দক্ষিণ চট্টগ্রামের অন্যতম জুলন্ত ব্রীজ। এই শীতের মৌসুমে পর্যটকদের আনন্দ দিতে আগে থেকে পার্ককে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। পার্কের ভিতরে রক্ষিত গাছ গুলো এবং বিভিন্ন স্থাপনায়  বিভিন্ন রকমের রং লাগিয়ে দৃশ্যমন করা হয়েছে। পার্কের অভ্যন্তরে দর্শনার্থীদের নির্বিঘনে আনন্দ উপভোগে করতে নিরাপত্তাকর্মীরা সজাগ রয়েছে। প্রতিদিনই পর্যটকরা দূর দুরান্ত থেকে ছুটে আসছে এই পার্কে। চট্টগ্রাম বন্দর নগরী  আগ্রাবাদ থেকে পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসে মোঃ জুনাইদ জানান, ইকোপার্কের জুলন্ত ব্রীজ ও প্রাকৃতিক সুন্দর যের  আনন্দই আলাদা। পার্কেও সু উচু পাহাড়ে উঠলে দেখা যায় বাঁশখালীর আরেক সুন্দরর্য্য তম স্পট সমুদ্র সৈকত ও পাহাড়ের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো উপভোগ করেছি । অপূর্ব সুন্দর লেগেছে”।

সাতকানিয়া উপজেলা থেকে আসা মোঃ সাকিব জানান, এই প্রথম বন্ধুদের নিয়ে পার্কে এসেছি। পার্কে দেশী বিদেশী পাখির কিচির মিচির ডাক সত্যিই দারুন। সব মিলিয়ে দেখা যায় আনন্দ উপভোগ করার জন্য বাঁশখালীই একমাত্র সুন্দর উপজেলা। এখানে আনন্দ উপভোগ করার মত সব কিছু রয়েছে।

পাশ্ববর্তী উপজেলার চকরিয়া থেকে আসা মোঃ সাইম ও সালেহা বিনতে তাবাছ্ছুম জানান, এই প্রথম বন্ধুদের নিয়ে পার্কে এসেছি। পার্কে দেশি বিদেশি পাখির কিচির মিচির ডাক সত্যিই দারুন। সব মিলিয়ে দেখা যায় আনন্দ উপভোগ করার জন্য বাঁশখালীই একমাত্র সুন্দর উপজেলা।পূর্বে পাহাড়, চা বাগান ও ইকোপার্ক ,পশ্চিমে মিনি কক্সবাজার ক্রাত বাঁশখালী সমুদ্র সৈকত,দক্ষিণে লবন, তারেক পার্ক, মৎস প্রজেক্ট সহ অশংখ পর্যটন স্পট, এখানে আনন্দ উপভোগ করার মত সব কিছু রয়েছে।

ইকোপার্কেও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আনিসুজ্জামান শেখ জানান, বর্তমানে বনবিভাগের পক্ষ থেকে ইকোপার্কের উন্নয়নের জন্য নানা ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যাতে করে ভ্রমণপিপাসুরা এখানে এসে নিরাপদে ভ্রমণ করতে পারেন এবং সবসময় পর্যটকরা নিরাপদে ভ্রমন করতে পারার জন্য বনবিভাগের পক্ষ থেকে সার্বক্ষণিক পাহারা রয়েছে।

এদিকে ইকোপার্কের উন্নয়ন পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম জীববৈচিত্র্য ও বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা আবু নাছের মোহাম্মদ ইয়াছিন নেওয়াজ বলেন, এই ইকোপার্ককে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ কর্মসূচির আওতায় নতুন করে কার্যক্রম গ্রহণের মাধ্যমে আধুনিক পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলা হবে। তাই সম্প্রতি জেলার মিটিংএ বাঁশখালী ইকোপার্ককে আধুনিক পর্যটন স্পট হিসেবে গড়ে তোলার জন্য প্রস্তাব প্রেরণসহ প্রকল্প গ্রহণে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

-সিভয়েস/এসসি

মুহাম্মদ মিজান বিন তাহের

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়