নেগেটিভ রিপোর্টে বিমানে উঠে নেমেই হলেন পজিটিভ!
সিভয়েস প্রতিবেদক
আরব আমিরাতের দুবাইয়ের আল-ছেরি এলাকার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শাহেদুল আলম। বাড়ি চট্টগ্রাম নগরের চান্দগাঁও থানার অদুরপাড়ায়। মহামারি করোনাতে আটকে পড়ে দীর্ঘদিন পর দেশে এসেছিলেন গেল মার্চে। পরিবার ও স্বজনদের সাথে সময় কাটিয়ে এক মাস পর দুবাই ফেরেন শাহেদ। তবে ফেরাটা সুখকর হয়নি। সেখানে ফিরে তাকে কাটাতে হচ্ছে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইন।
তিনি সিভয়েসকে জানান, গত ৫ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে করোনার নমুনা দেন। পরের দিন সকালে তার করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ আসায় সন্ধ্যায় বাংলাদেশ বিমানের একটি ফ্লাইটে দুবাইয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেন। ৫ ঘণ্টার ভ্রমণ শেষে মধ্যরাতে দুবাই বিমান বন্দরে নেমে যখন সে দেশের নিয়ম অনুযায়ী করোনা পরীক্ষা করানো হয় তখনই তার রিপোর্ট পজিটিভ আসে। ২৪ ঘন্টার কম সময়ের ব্যবধানে বিমান থেকে নেমেই তার শরীরে করোনা ভাইরাসের অস্তিত্ব থাকার খবরে তিনি হতবাক হয়ে যান। পরে দুবাই পুলিশ তাকে ১৪ দিনের বাধ্যতামূলক কোয়ারেন্টাইনে পাঠান।
নমুনা দেওয়ার একদিনের ব্যবধানে এই ধরনের নেগেটিভ-পজিটিভ রিপোর্ট আসাকে স্বাভাবিকই দেখছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। এর জন্য তিনটি কারণ দেখছে তারা। যদিও এই ধরনের রিপোর্টের কারণে বিদেশের শ্রম বাজারে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবার আশংকা করছেন সে দেশের প্রবাসী ব্যবসায়ীরা। শুধু এরকম একজনের করোনা রিপোর্ট নেগেটিভ বিদেশ গিয়ে পজিটিভ হয়েছে তা নয়। এর আগেও চট্টগ্রামের অনেক প্রবাসীর ক্ষেত্রে তা হয়েছে উল্লেখ করে বিষয়টি খতিয়ে দেখতে খোদ চট্টগ্রামের স্বাস্থ্য বিভাগকে চিঠি দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
বাংলাদেশ থেকে আকাশ ও স্থল পথে বিদেশগামী সকল যাত্রীদের জন্য করোনাভাইরাসের পরীক্ষা করাতে পরীক্ষা কেন্দ্র নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এসব কেন্দ্র থেকে করোনাভাইরাসের পরীক্ষার নেগেটিভ সনদ নিয়ে তবেই বিমানে ওঠা যাবে। সেই হিসেবে র্দীঘ লাইন ধরে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বেসরকারি একটি ক্লিনিক থেকে বিদেশগামীরা করোনা পরীক্ষা দিয়ে সার্টিফিকেট নিয়েই বিমানে ওঠে থাকেন। এই করোনা পরীক্ষা করতে গিয়েই অব্যবস্থাপনা ও সামাজিক দূরত্ব না মেনেই জেনারেল হাসপাতালে নমুনা নেয়া হয় বিদেশগামীদের। অনেক সময় সেখান থেকেই আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
দুবাই থেকে শাহেদ বলেন, ‘আমি ৫ এপ্রিল দুপুর ১২টার দিকে চট্টগ্রামের জেনারেল হাসপাতালে বিদেশগামী যাত্রী হিসেবে করোনা পরীক্ষা করাই। ৬ তারিখ সন্ধ্যায় বিমানে উঠার আগে দুপুরে পাওয়া রিপোর্টটি নেগেটিভ ছিল। তবে একইদিন রাতে দুবাই বিমানবন্দরে নেমেই পরীক্ষা করালে তারা ভিন্ন রিপোর্ট দেই। এখানকার পুলিশ জানায়, দেশ থেকে আনা রিপোর্টে নেগেটিভ থাকলেও, এখানে আমি পজিটিভ।’
তিনি জানান, বিমানবন্দর থেকে সোজা ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইনে পাঠায় সেখানকার স্থানীয় কর্তৃপক্ষ। তবে আক্রান্ত হলেও শরীরে তেমন কোনো জটিলতা নেই তার। যদিও নেগেটিভ না আসা পর্যন্ত এভাবে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হবে বলে জানান তিনি।
২৪ ঘন্টার ব্যবধানে এমন ভিন্ন ভিন্ন রিপোর্ট পাওয়া নিয়ে বিরক্তি শোনা গেল তার কণ্ঠে। কীভাবে এমন ঘটনা ঘটলো তার কোন কুলকিনারা করতে পারছেন না এই ৩১ বছর বয়স্ক তরুণ ব্যবসায়ী। বললেন, ‘দেশে থাকায় এমনিতেই ব্যবসা কিছুদিন বন্ধ ছিল। তার উপর কোয়ারেন্টাইনে থাকায় ব্যবসায় নিয়ে লোকসানের শংকায় আছি।’
জানা গেছে, শাহেদ করোনার নমুনা জেনারেল হাসপাতালের রিজিওনাল টিবি রেফারেল ল্যাবরেটরিতে দিলেও পরীক্ষার ফলাফল দেয়া হয় চট্টগ্রামের ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকসাস ডিজিজেস (বিআইটিআইডি) থেকে।
এ ব্যাপারে জানতে সেখানকার ল্যাবরেটরি ইনচার্জ অধ্যাপক ডা. শাকিল আহমেদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘ওই ব্যক্তি দেশে যখন নমুনা দিচ্ছিলেন তখন শরীরে ভাইরাস সুপ্ত অবস্থায় ছিল। এমন ঘটনা হতে পারে। এটি অস্বাভাবিক কিছু নয়। সাধারণত অনেক রোগীর শরীরে প্রথম ২৪ ঘন্টায় ভাইরাস ধরা পড়ে না। এটি দুই তিনদিন সুপ্ত বা ইনকিউবিটরি স্টেজে থাকে। তাই এই ক্ষেত্রেও এমনটি হয়েছে বলেই আমার ধারণা।’
‘হয়তো এমনও হতে পারে যে, জেনারেল হাসপাতালে তিনি ৫ তারিখ নমুনা দেয়ার পর বিভিন্ন স্থানে গেছেন। হয়তো দেশ ত্যাগের আগে কোনো আত্মীয়ের কাছে গেছেন, শপিং করেছেন বা অনেক মানুষের সংস্পর্শে এসেছেন সেখানে সংক্রমিত হতে পারে’ —যোগ করেন ডা. শাকিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রামের ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন ডা. আসিফ খান বলেন, এ ধরনের রিপোর্ট-বিভ্রান্তির অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে সবচেয়ে ভাল সমাধান হতে পারে যদি বিদেশগামী যাত্রীরা নমুনা দেয়ার পর বিমানে উঠার আগ পর্যন্ত কোয়ারান্টইনে থাকেন।
এমন রিপোর্ট সম্পকে ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন বলেন, এই ধরনের প্রতিবেদন তিন কারণে হতে পারে। এক, নমুনা দেওয়া ব্যক্তির ভাইরাসটি যদি দুই তিনদিন সুপ্ত বা ইনকিউবিটরি স্টেজে থাকে। দুই, তিনি নমুনা দিয়ে বিমানে উঠার আগ পর্যন্ত আক্রান্ত কারো সংস্পর্শে আসছেন হয়তো। তিন, প্রত্যেক দেশেই পিসিআর মেশিনে শতকরা ২৫ ভাগ প্রতিবেদন সঠিকটা আসে না। হয়তো ওনারটাও সেই ২৫ ভাগের মধ্যে পড়েছে।’
এদিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ের সূত্রে জানা গেছে, রিপোর্ট নিয়ে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন জেলার স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের চিঠি পাঠিয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ল্যাব পরীক্ষায় রিপোর্টের সাথে বিদেশের পরীক্ষার মিল না থাকার কারণ জানতে চেয়েছে মন্ত্রণালয়।
চট্টগ্রাম জেলায় এমন ৫ থেকে ৬টি রিপোর্টের কারণ জানতে চেয়ে স্বাস্থ্য পরিচালক ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে মন্ত্রণালয়। এ ধরনের সংকট মোকাবেলায় স্থানীয় ল্যাব কর্তৃপক্ষ ও সিভিল সার্জন অফিস থেকে বেশ কিছু সুপারিশ পাঠানো হয়েছে।