ফাগুনে আগুন বাড়ে!

আবরার শাহরিয়ার, সিভয়েস২৪

প্রকাশিত: ১২:১৬, ১৭ মার্চ ২০২৪
ফাগুনে আগুন বাড়ে!

একদিকে শিল্পপ্রতিষ্ঠান তো অন্যদিকে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নির্মাণের সঙ্গে যুক্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান, কিংবা দোকান বসতঘর। রেলওয়ের পরিত্যক্ত বগিও! হঠাৎ ‘অজানা'  আগুনে পুড়েছে একের পর এক। রাজধানীর বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডে যখন শোকাতুর দেশ ঠিক তখনই এমন লাগাতার আগুন চট্টগ্রামে। এমন অগ্নিকাণ্ড ভাবিয়ে তুলেছে সাধারণ মানুষকে। নিছক দুর্ঘটনা, নাশকতা, নাকি অন্যকিছু— এসব ভাবারও সময় এসেছে!

সম্প্রতি জেলা প্রশাসক (ডিসি) সম্মেলনে কেন একের পর এক অগ্নিকাণ্ড হচ্ছে, জেলার শীর্ষ কর্তাদের তা খতিয়ে দেখতে বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টাও। বেইলি রোডের অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের মহাপরিচালকও তদন্তের তাগিদ দিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ সব গোয়েন্দা সংস্থার প্রতি। এবার রমজানে ঈদবাজার ঘিরে অগ্নিকাণ্ডকে সবচেয়ে বড় ‘থ্রেট’ বলে মনে করছেন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি) কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায়। তাই অন্য সব প্রস্তুতির চেয়ে এবার অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রস্তুতির ওপর সংশ্লিষ্টদের জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি।

যদিও ফায়ার সার্ভিসের পরিসংখ্যান বুড়াবুড়ির 'ফাগুনে আগুন বাড়ে' গল্পে ফিরিয়ে নিচ্ছে।

নগর-গ্রামে মার্চেই ছোট-বড় অর্ধশতাধিক অগ্নিকাণ্ড 

চলতি মাসের শুরুতে নগরের বাকলিয়া এক্সেস রোডে দেশের অন্যতম শিল্পগোষ্ঠী এস আলম গ্রুপের নির্মাণাধীন হিমাগারে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত। ১ মার্চ সকাল সাড়ে ১০টার দিকে অগ্নিকাণ্ড, খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের একটি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে। তবে আগুন কোনোভাবে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না, একে একে ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে দুপুর ২টার দিকে। পুরোপুরি নেভাতে সময় লেগেছে বিকেল চারটা নাগাদ। এতে প্রাণহানির কোনো ঘটনা না ঘটলেও বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। 

এর ঠিক দুদিন পর ৪ মার্চ বিকেলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বৃহত্তম এ শিল্পগোষ্ঠীর আরেকটি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। কর্ণফুলীর দক্ষিণ পাড়ে এস আলম সুগার মিলের ওই আগুন জ্বলে টানা চারদিন। নিয়ন্ত্রণে আনতে কাজ করতে হয় ফায়ার সার্ভিস, বিমান সেনা, নৌবাহিনীকেও। এ ঘটনায়ও কেউ হতাহত হয়নি। তবে দুর্ঘটনা ক্ষত রেখে গেছে কর্ণফুলীর বুকে। কারখানার দেয়ালে ফুটো করে বের করে দেওয়া পোড়া অপরিশোধিত চিনি মিশ্রিত বিষাক্ত তরল পড়েছে কর্ণফুলীতে গিয়ে। 

৭ মার্চ রাতে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে জয় বাংলা কনসার্ট চলাকালীন সময়ে রাত সাড়ে ৯টার দিকে আগুন লাগে অল্পদূরে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স কন্সট্রাকশনের অস্থায়ী একটি শেডে। দেড় ঘণ্টার চেষ্টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা গেলেও এরপরই অগ্নিকাণ্ডের আরেক ঘটনা ঘটে পশ্চিম মাদারবাড়ির বাংলাবাজার এলাকায় রেলওয়ের পরিত্যক্ত বগিতে। 

সবশেষ শনিবার চট্টগ্রাম নগরের রাইফেল ক্লাবের নিচতলায় ইউসিবিএল ব্যাংকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৬টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। 

এ ছাড়া শহর গ্রাম-মিলে অর্ধশতাধিক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রামে।

একের পর এক অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে ফায়ার সার্ভিস কর্তৃপক্ষ কতটা ‘ভাবাতুর’ জানতে ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা প্রত্যাশিত না। তবে বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড দুর্ঘটনাই বলে মনে হয়েছে প্রাথমিকভাবে। আমাদের তদন্ত কার্যক্রম চলমান রয়েছে। তদন্তের পরপরই আসলে বলা যাবে দুর্ঘটনা নাকি অন্যকিছু।’

চট্টগ্রামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নাশকতার চোখে দেখছেন না জানিয়ে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশের মুখপাত্র অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ডিএসবি) আবু তৈয়ব মো. আরিফ বলেন, ‘চট্টগ্রামের ঘটনাগুলো আমরা সেভাবে দেখছি না। তবে পুলিশ সবসময়ের মতো এসব ঘটনায় সজাগ রয়েছে।’

তবে নগর পুলিশ কমিশনার কৃষ্ণ পদ রায় এবার রমজানে ঈদবাজার ঘিরে অগ্নিকাণ্ডকে সবচেয়ে বড় ‘থ্রেট’ বলে মনে করছেন।  তাই অন্য সব প্রস্তুতির চেয়ে এবার অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে প্রস্তুতির ওপর সংশ্লিষ্টদের জোর দেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি দামপাড়া পুলিশ লাইনে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি এ কথা বলেন।

ফাল্গুনে বাতাসের কারণে মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় আগুন

সাম্প্রতিক সময়ে চট্টগ্রামে ঘটে যাওয়া বেশিরভাগ অগ্নিকাণ্ড বসতঘর কিংবা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে। ফাল্গুনের এ সময়টাতে বাতাসের কারণে আগুন মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায়। ফলে আগুন নেভাতে নেভাতে ক্ষতির পরিমাণ বেড়ে যায়।

চট্টগ্রাম আবহাওয়া অফিসের আবহাওয়া পূর্বাভাস কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, ‘সাধারণ শুষ্ক মৌসুমেই অগ্নিকাণ্ডের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। কারণ আবহাওয়া শুষ্ক থাকায় আগুন খুব সহজে জ্বলে উঠতে পারে। কিন্তু বর্ষার সময় সেটা হয় না। এখন কেউ সিগারেটের ফিল্টার কোথাও ফেললো, সেটা থেকে আগুন খুব সহজেই আগুন ধরে যেতে পারে।’

ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রাম বিভাগের উপ-পরিচালক দিনমনি শর্মা বলেন, ‘সচরাচর বাসাবাড়ি ও আবাসিক হোটেলে আগুনের ঘটনা বেশি ঘটে। এসব স্থানে সাধারণত মানুষের অসাবধানতায় অগ্নিকাণ্ড ঘটে। কিছু কিছু অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে বৈদ্যুতিক গোলযোগ থেকে।’

অগ্নিকাণ্ডের পাশাপাশি আছে বিস্ফোরণের ঘটনাও

এস আলম সুগার মিলে অগ্নিকাণ্ডের রাতেই কর্ণফুলী উপজেলায় আরেকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। গোয়াল ঘরে দেওয়া কয়েল থেকে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের বেশ কয়েকটি ঘরে। দুটি গরু অঙ্গার, ঘরহারা ৪০ পরিবার। পরদিন ভোরে লোহাগাড়া উপজেলার বড়হাতিয়া মনুফকির হাটে আগুনে পুড়ে গেছে ১৫টি দোকানঘর। গত এক মাসে এমন আরো ঘটনা চট্টগ্রামের লোহাগাড়া, বাঁশখালী, বোয়ালখালী, আনোয়ারা, কর্ণফুলী ও সাতকানিয়া উপজেলায়।

এদিকে শনির দশা যেন কাটছেই না চট্টগ্রামে। একের পর অগ্নিকাণ্ডের মতো গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে ঘটনা ঘটেছে নগর-গ্রামে। এতে হতাহতের সংখ্যাও নেহায়েত কম নয়। গত ৭ মার্চ দুপুর নাগাদ সেফটিক ট্যাংক পরিস্কারের সময় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে আগ্রাবাদের ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল ভবনে। এতে দগ্ধ হন পাঁচজন, এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আশঙ্কাজনক অবস্থায় চিকিৎসাধীন চারজন।

একইদিন সকাল ১০টার দিকে বাঁশখালী উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের মোশাররফ বাজার এলাকায় গাড়ির গ্যারেজে গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে দগ্ধ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি অন্তত ১৫ জন।

এর মধ্যে ওই দিন মধ্যরাতে নগরের চান্দগাঁওয়ের বাহির সিগন্যাল এলাকায় বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। উড়ে গেছে বাড়ির চালা, ভেঙে চুরমার ইটের দেয়াল। সিলিন্ডার নাকি গ্যাস লাইনের লিকেজ তা জানা যায়নি।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়