ফেসবুক প্রতিক্রিয়া/ একশ বছরের ফ্লাইওভারে চার বছরেই ফাটল

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৬:১৬, ২৬ অক্টোবর ২০২১
ফেসবুক প্রতিক্রিয়া/ একশ বছরের ফ্লাইওভারে চার বছরেই ফাটল

উদ্বোধনের চার বছরের মাথায় এম এ মান্নান ফ্লাইওভারের (বহদ্দারহাট) দু’টি পিলারে ফাটল দেখা দিয়েছে। এতে একাংশে যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। তবে ফ্লাইওভারে এমন ফাটল দেখা দেওয়ায় জনমনে বেড়েছে আতঙ্ক। কেননা, উদ্বোধনের আগেই ফ্লাইওভারের গার্ডার পরে হতাহতের ঘটনা ঘটেছিলো। সেই ক্ষত চাপা পড়তে না পড়তেই নতুন করে দুর্ঘটনার শঙ্কা দেখা দেওয়ায় ক্ষোভে ফুসছে সাধারণ মানুষ। ক্ষোভ ঝাড়ছেন কর্তৃপক্ষের ওপরও।

এদিকে অনেকে আবার ফ্লাইওভারের সঙ্গে চট্টগ্রামের কালুরঘাট ব্রিজের তুলনাও করছেন। তারা বলছেন, কালুরঘাট ব্রিজ শতবর্ষীর দ্বারপ্রান্তে হলেও এখন পর্যন্ত তেমন কোনো বিধ্বস্তের ঘটনা ঘটেনি। অথচ ফ্লাইওভার উদ্বোধনের ৪ বছরের মাথায় আবারও বিপদ সংকেত দেখা দিয়েছে। এ নিয়ে ফেসবুকে সমালোচনার ঝড় ওঠেছে।

সমালোচনাকারীরা বলছেন, ফ্লাইওভারের কাজ পুরোপুরি নির্মাণ হওয়ার আগেই একবার গার্ডার পরে অনেক মানুষ নিহত হয়েছিলেন। এখন ৪ বছর না যেতেই আবার বিপদের সম্মুখীন হতে হবে চট্টগ্রামবাসীকে। অথচ এ নিয়ে যেন কারো কোনো মাথা ব্যাথা নেই। সিডিএকে বললে সিডিএ দোষ দেয় চসিককে। আবার চসিকের কাছে গেলে দোষ দেই সিডিএর। হয়তো এমন সমস্যা থেকে কখনও মুক্তি মিলবে না চট্টগ্রামবাসীর।   

সমালোচনাকারীরা আরও বলছেন, শুধু বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারই নয়; হয়তো চট্টগ্রামের বাকি ফ্লাইওভারগুলোতেও এমন বিপদের সম্মুখীন দেখা দিতে পারে। তাই এখন থেকে প্রকোশলীদের নজরদারি আরও বাড়াতে হবে বলেও অভিমত ব্যক্ত করেন তারা। 

পাঠকদের সুবিধার্থে ফ্লাইওভারের ফাটল নিয়ে সিভয়েস ফেসবুক পেজে করা পাঠকদের কমেন্টস হুবহু তুলে ধরা হলো—

মঈনুল ইসলাম নামে এক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘গায়ের জোর থাকলে কাউকে জবাবদিহি করতে হয় না, শুধু ফ্লাইওভার না দেশের সব প্রতিষ্ঠান, সব ক্ষেত্রে ফাটল ধরেছে, কেউ দেখে কেউ দেখে ও দেখে না, বলেন না। এ-ই ফ্লাইওভারের কারণে মানুষ তো মরবে একসময় দেখবেন মানুষ অলি গলি খুঁজবে হাঁটার জন্য। জানের ভয়ে ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে কেউ হাটতে সাহস করবে না। নিন্দা ঘৃণা কিছুই করছি না। আক্ষেপ শুধু। জোর যার মুল্লুক তার।’

পাবনা জেলার হার্ডিঞ্জ ব্রিজের কথা উল্লেখ করে মিরাজুল ইসলাম জুয়েল লিখেছেন, ‘আমরা জানি হার্ডিঞ্জ ব্রিজটা আজ থেকে শত বছর আগের করা, তা এখনো অক্ষত অবস্থাতে আছে। এখন বাংলাদেশের জনগণের বুঝতে হবে বর্তমানের বাংলাদেশের উন্নয়ন কতটা টেকশোই ও নিরাপদ।’

এদিকে কালুরঘাট ব্রিজের সঙেগ তুলনা করে ইউসুফ রাজা সোয়েব লিখেছেন, ‘কালুরঘাট সেতু নির্মাণ করা হয়েছিল আজ থেকে ১০০ বছর আগে আর এই ফ্লাইওভার উদ্বোধন করা হয়েছিল 8 বছর আগে, আহারে আমার দেশের দুর্নীতি।’

ওয়াহাব লিখেছেন, ‘রাস্তায় যানজটে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে জনগণ ফ্লাইওভার উপভোগ করে!’ খন্দকার তালহা লিখেছেন, ‘রডের বদলে বাশ দিয়ে উন্নয়ন করলে তার ফলাফল এমন ই হবে!’ আরেক ফেসবুক ব্যবহারকারী লিখেছেন, ‘আমি আর উন্নয়নের রোল মডেল এর মহাসড়কে যেতে চাই না আমি যেতে চাই সেই গ্রাম বাংলার মেঠোপথে আমার এমন উন্নয়নের দরকার নাই।’

মোহাম্মদ হুমায়ুন কবীর সানি লিখেছেন, ‘প্রকল্প থেকে টাকা বাচিয়েছে। প্রকল্পের কি অবস্থা কেমন কাজ, কি তার মান তা দেখার দরকার নাই।’ আসিফুর রহিমান লিখেছেন, ‘অসাধারণ! যে অংশের কাজ ২০১৬ সালে CDA নিয়েছিলো ওই অংশেই ফাটল। ১২০ কোটি টাকার প্রকল্পের মেয়াদ ৪ বছর।‘ 

মোহাম্মদ সেলিম লিখেছেন, ‘অতিরিক্ত পণ্যবোঝাই ট্রাক যদি চলাচল করে তাহলে অতি দ্রুত ফ্লাইওভার ভেঙে পড়বে। এগুলো দেখার কেউ নাই, ট্রাফিক বিভাগ তো নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছে। ভোগান্তি তো জনগণের হবে।’ সঞ্জয় শম লিখেছেন, ‘এই ফ্লাইওভার আর কত প্রাণ নিবে ঈশ্বর জানে...।’ সরোয়ার আলম লিখেছেন, ‘আর একটি দুর্ঘটনার অপেক্ষায় আছি। আমি আপনি যে কার সাথে হতে পারে।’ মোহাম্মদ আরফান উল্লাহ লিখেছেন, ‘অযোগ্য ঠিকাদারকে আনলে, সজনপ্রীতি চললে এই রকম হইবে।’

রাশেদুল ইসলাম সাথী লিখেছেন, ‘২ টাকার কাজ ২০০০ টাকার প্রকল্প বানিয়ে সেই ২ টাকা থেকেও ১.৫ টাকা খেয়ে নিল??? আহ! পিলার টা যে খেয়ে নেয়নি এই বড় ভাগ্য উন্নয়নের মহাসড়কের পথিকদের!!!!’ নাহিদুল হাসান লিখেছেন, ‘মাঝে মধ্যে মনে হয় দেশের দুই মেগা সিটি ফ্লাইওভারের নিচে চাপা পড়ে আছে। আমরা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছি না। সবসময় সংশয় কাজ করে নাজানি কখন কোনদিকে ভেঙে যায়।’

আব্দুর রাজ্জাক লিখেছেন, ‘দুর্নীতির ফল এগুলো। প্রকল্পের সাথে জড়িত সবাইকে গ্রেফতার করা উচিত।‘ মাহমুদুল সায়েম লিখেছেন, ‘একটি স্থাপনা ১০০ বছর এর স্থায়ীত্ব নিয়ে করা হয়। ৪ বছরেই ফাটল?’

রহমত কাইয়ুম লিখেছেন, ‘কালুরঘাটমুখী এই র‍্যাম্প মূলত মূল নকশা বহির্ভুত ও বর্ধিতাংশ। এটি লাইট যানবাহনের জন্য উপযোগী ছিল। কিন্তু এখানে ৪০/৫০ টন লোডেড কাভার্ডভ্যান চলাচল করলে এই অবস্থা তো হবেই।’

এমডি রাজিবুল আলম লিখেছেন, ‘ভারি মালামাল বোঝায় ট্রাক লরিগুলো ফ্লাইওভারে চলাচলের জন্য এই অবস্থা তৈরি হয়েছে (সাথে নিম্নমানের কাজও দায়ী)। আক্তারুজ্জামান ফ্লাইওভারের ট্রাক-লরি চলাচল বন্ধ করতে হবে, তা না হলে কয়েক বছর পর এটারও এমন দশা হবে।’

এদিকে আজ মঙ্গলবার সকালে বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পের পিলারে ফাটল পরিদর্শন করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র এম রেজাউল করিম চৌধুরী। এসময় তিনি এ ঘটনার দায় চাপিয়েছেন বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) ওপরে। তিনি বলেছেন, নির্মাণ ত্রুটির কারণেই ফাটল দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম ও সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান এই ফাটলের জন্য ওভারলোডকেই দুষছেন। যদিও চসিকের প্রধান প্রকৌশলী আরও দুটি সম্ভাব্য কারণ উল্লেখ করেছেন।

সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, দুটি কারণে ফাটল দেখা দিতে পারে। একটি নকশাগত ত্রুটি, অন্যটি নির্মাণ ত্রুটি। কি কারণে হয়েছে সেটা দেখে এ মুহূর্তে বলা যাবে না। তবে এটা ওভারলোডের গাড়ি চলাচলের কারণে এটা হয়েছে। নির্মাণে যুক্ত থাকা প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সের সঙ্গে কথা বলেছি। এই র‍্যাম্পটা মূল নকশায় ছিল না। পরবর্তীতে এটা বর্ধিত করা হয়েছে। এ জন্য ডিজাইনের ত্রুটি থাকতে পারে। 

অন্যদিকে সিডিএর নির্বাহী প্রকৌশলী ও প্রকল্প পরিচালক মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘ফ্লাইওভারের র‌্যাম্পের নকশার কোনো ত্রুটি নেই। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত ভারী যানবাহন চলাচলের কারণে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। এটি ভারী যানবাহন চলাচলের উপযোগী নয়। শুরুতে প্রবেশমুখে ভারী যানবাহন চলাচলে প্রতিবন্ধকতা দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিচের সড়কে ওয়াসার খোঁড়াখুঁড়ির কারণে সে প্রতিবন্ধকতা কে বা কারা খুলে দিয়েছিল। ফলে প্রতিনিয়ত ভারী গাড়ি চলাচল করছে। এই কারণে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে।’

তিনি দাবি করেছেন, ফাটল দেখা দিলেও তা সংস্কার বা মেরামত করার সুযোগ রয়েছে। এ জন্য কিছুদিন র‌্যাম্পে যান চলাচল বন্ধ রাখতে হবে। আর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বিশেষজ্ঞদের সহযোগিতা ও পরামর্শে তা সংস্কার করা হবে। 

এরআগে, গতকাল (২৬ অক্টোবর) বহদ্দারহাট ফ্লাইওভারের দুটি পিলারে ফাটল দেখা দেওয়ায় রাত সাড়ে দশটার দিকে যানবাহন চলাচল বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় চসিক ও সিএমপির ট্রাফিক বিভাগ। সিএমপির পক্ষ থেকে ব্যারিকেডের পাশাপাশি সেখানে দু'জন ট্রাফিক সদস্য নিয়োগ দেওয়া হয়। 

এর আগেও দুর্ঘটনা ঘটেছিল ফ্লাইওভারটিতে। ২০১২ সালের ২৯ জুন একটি গার্ডার হঠাৎ ধসে পড়ে। এতে একজন রিকশাচালক সামান্য আহত হন। এরপর একই বছরের ২৪ নভেম্বর ফ্লাইওভারের তিনটি গার্ডার ধসের ঘটনা ঘটে। এতে ১২ জন নিহত হন। 

প্রসঙ্গত, যানজট নিরসনে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (সিডিএ) নগরের শুলকবহর থেকে বহদ্দারহাট এক কিলোমিটার এলাকা পর্যন্ত এম এ মান্নান ফ্লাইওভার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ২০১০ সালের জানুয়ারিতে প্রধানমন্ত্রী ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১২ সালের নভেম্বরে ফ্লাইওভারের গার্ডার ধসের ঘটনায় ১৪ জন নিহত হলে এর নির্মাণ কাজ তদারকির দায়িত্ব পায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। নির্মাণ কাজ শেষে ২০১৩ সালের ১২ অক্টোবর ফ্লাইওভারের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তবে উদ্বোধনের পর ফ্লাইওভারটি কার্যকর না হওয়ায় ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে আরাকান সড়কমুখী র‌্যাম্প নির্মাণের উদ্যোগ নেয় সিডিএ। ৩২৬ মিটার দীর্ঘ এবং ৬ দশমিক ৭ মিটার চওড়া র্যাম্পটি নির্মাণ শেষে ২০১৭ সালের ডিসেম্বরে যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয়।

প্রথমে প্রকল্পটির প্রাক্কলিত ব্যয় ছিল ৯১ কোটি টাকা। পরে সংশোধন করে ১০৬ কোটি টাকা করা হয়। ফের সংশোধন করে প্রকল্প ব্যয় ১২০ কোটি টাকা করা হয়। ১৩৩২ মিটার দৈর্ঘ্য ফ্লাইওভারটির প্রস্থ ১৪ মিটার। চার লেনের বহদ্দারহাট এ ফ্লাইওভারের দুই পিলারের দূরত্ব ১৩০ ফুট।

-সিভয়েস/এমএম

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়