সময় ও ব্যয় বেড়েছে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্পে

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ১৭:২৫, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২২
সময় ও ব্যয় বেড়েছে ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্পে

বায়েজিদ লিংক রোড। ছবি: সিভয়েস

চলতি বছরের ডিসেম্বরে ৩২০ কোটি টাকায় শেষ হওয়ার কথা ছিল ফৌজদারহাট-বায়েজিদ লিংক রোড প্রকল্পের কাজ। কিন্তু শেষ সময়ে এসে সংশোধন, পরিবর্ধনের অজুহাতে আবারও বাড়ানো হয়েছে প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়। ৩২ কোটি টাকা বেড়ে প্রকল্পের ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩৫২ কোটি টাকা। মেয়াদ বেড়েছে ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত।

সম্প্রতি প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের অগ্রগতির ডিজাইন পরিবর্তনের অজুহাতে সিডিএ প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়িয়ে সিডিএর পাঠানো সংশোধিত ডিপিপি মন্ত্রণালয় অনুমোদনও দিয়েছে। তবে বাড়তি অর্থ জিওবি ফান্ড থেকে চাইলেও সেই অর্থ দিতে নারাজ মন্ত্রণালয়। ফলে বাড়তি অর্থ যোগান দিতে হবে সংস্থাটিকেই। 

সিডিএ সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর মাসে শেষ হওয়ার কথা ছিলো  বায়েজিদ ফৌজদারহাট লিংক রোড প্রকল্পের কাজ। সম্প্রতি সিডিএ প্রকল্পটির সংশোধিত ডিপিপি (ডিটেইল প্রজেক্ট প্ল্যান) মন্ত্রণালয়ের পাঠানোর পর নতুন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করে। মেয়াদ বাড়ানোর কারণ হিসেবে প্রকল্পের বিভিন্ন কাজের অগ্রগতির ডিজাইন পরিবর্তনের বিষয়টি তুলে ধরেছে। ওই হিসেবে ২০২৩ সালের ২৩ জুন পর্যন্ত প্রকল্পের নতুন সময় নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ৩২০ কোটি টাকা প্রকল্পের কাজ গিয়ে ঠেকেছে ৩৫২ কোটি টাকা। তবে ব্যয় বৃদ্ধির এই টাকা সিডিএর নিজস্ব তহবিল থেকে বহনের নির্দেশ দিয়েছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়।

প্রকল্পের কাজে পরিবর্তন-পরিবর্ধন কি করা হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে কর্মকর্তা তা না জানালেও পাহাড় কাটা, ওভার ব্রিজের গার্ডার, পাহাড়ের মাটি অপসারণ, বেশ কিছু কালভার্টের সংস্কারে এ অর্থ ব্যয় করা হবে বলে জানা গেছে।

জানতে চাইলে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট সড়কের প্রকল্প পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার সিভয়েসকে বলেন, প্রকল্পটি চালুর পর ওই সড়কে গাড়ির চাপ বেড়ে গেছে। এরপর দুই লেইন থেকে প্রকল্পটিকে চার লেইনে নিয়ে আসতে হয়েছে। এছাড়া ডিজাইন পরবর্তনসহ বেশ কিছু কাজ করতে হয়েছে। যার কারণে প্রকল্পের সময় ও ব্যয় দুটি বেড়েছে। আমরা মন্ত্রণালয় থেকে সংশোধিত প্রকল্প অনুমোদন পেয়েছি। তবে অর্থের সংস্থান করতে হবে সিডিএ’কে।

টোল আদায়ের বিষয়ে তিনি বলেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করতে গিয়ে এখন সিডিএর কিছু ফান্ড ব্যবহার করতে হচ্ছে। এ লক্ষ্যে প্রকল্পের সংশোধিত নতুন ডিপিপিতে আমরা টোল আদায়ের বিষয়টি রেখেছি। এখনও এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। কীভাবে করা হবে, কি কি বিষয় থাকবে এসব নিয়ে পরিকল্পনা চলছে।

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসের সঙ্গে। তিনি সিভয়েকে বলেন, নতুন ডিপিপি অনুসারে প্রকল্পের সময় ও মেয়াদ বাড়ানোর আবেদন করা হয়েছে। আমরা চেয়েছিলাম রিভাইজড ডিপিপির ৩২ কোটি টাকা জিওবি থেকে নেওয়ার। অর্থ মন্ত্রণালয়  আপত্তি জানিয়ে এই টাকা সিডিএ থেকে বহন করতে বলেছেন। আশা করছি নির্ধারিত সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ করা যাবে।

এদিকে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা ছাড়া প্রকল্প হাতে নেওয়া বারবার মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ছে বলে মনে করছেন পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সহসভাপতি ও প্রকৌশলী সুভাষ বড়ুয়া। 

তিনি সিভয়েসকে বলেন, কেবল উন্নয়ন দেখাতে গিয়ে এসব প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু প্রকল্পটির সুবিধাভোগী, কোথায় কোথায় অসঙ্গতি রয়েছে এসব যাচাই-বাছাই করা হয় নি। যার কারণে বার বার মেয়াদ ও খরচ বাড়লেও জনগণ অনেকাংশে কাঙিক্ষত সেবা পাচ্ছে না। এরকম প্রকল্প মন্ত্রণালয় অনুমোদন দেয় কীভাবে সেইও প্রশ্নও রাখেন এই প্রকৌশলী।

টোল তুলে ব্যয় মেটানোর ‘খায়েশ’

সংশোধিত প্রকল্পের বাড়তি ৩২ কোটি টাকার ‘শোধ’ তুলতে ৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এ সড়কে টোল আদায় করতে চায় চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ। তবে কবে নাগাদ কোন গাড়ি থেকে কি পরিমাণ থেকে টোল আদায় করা হবে তা নিয়ে এখনো কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি সংস্থাটি।

সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, প্রকল্পের ব্যয় ও সময় বাড়িয়ে অনুমোদন দিলেও বাড়তি টাকা দিতে নারাজ অর্থ মন্ত্রণালয়। বাড়তি টাকা বহন করতে হবে সিডিএ‘কে।  সিডিএ’র তো এত টাকা নেই। এ টাকা তুলতে টোল আদায়ের প্রস্তাব করা হয়েছে।

রেল-সিডিএ দ্বন্দ্বে আটকে আছে দুই ওভারপাস

উচ্চতা নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণে প্রায় দুই বছর ধরে আটকে আছে ওভারব্রিজ নির্মাণ কাজ। ২০১৬ সালে যখন প্রকল্পটির কাজ শুরু হয় তখন ওভারপাসের জন্য রেলওয়ে নির্ধারিত উচ্চতা ছিল ৬ দশমিক ৫ মিটার। দুবছর পর ২০১৮ সালে সেটা বাড়িয়ে করা হয় ৭ দশমিক ৫ মিটার। রেলওয়ের সেই উচ্চতা ধরেই ওভারপাস নির্মাণের কাজ শুরু করে সিডিএ। এর দুবছর পর রেলওয়ে আপত্তি জানায় উচ্চতা নিয়ে। ভবিষ্যতে ডাবলডেকার কনটেইনার ট্রেনের পরিকল্পনা সাজাতে গিয়ে ওভার ব্রিজের উচ্চতা ৮ দশমিক ৫ মিটার নির্ধারণ করে দেয়। এই উচ্চতা নিয়ে বেধেছে বিপত্তি।

সরকারের দুই সংস্থার মধ্যে চিঠি চালচালি, কমিটি গঠন, সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা- সবই হয়েছে; কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। সবশেষ সিডিএ ও রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মধ্যে একটি চুক্তি হয়েছে বলে জানা গেছে। চুক্তিতে চলতি প্রকল্পটি বিদ্যামান অবস্থায় শেষ করার বিষয়ে সিডিএর পক্ষ থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রেলওয়ে কোনো প্রকল্প হাতে নেওয়া হলে পরবর্তীতে নিয়ম অনুযায়ী দু’বছর আগে ওভার ব্রিজটি ভেঙে ফেলার অঙ্গীকার করা হয়েছে। তবে তারও কোন অনুমোদন মিলেনি এখনো। বিষয়টি নিয়ে সিডিএ নালিশ করেছে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে। 

সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস বলেন, দুই পক্ষের সমন্বয়ে একটি কমিটি বর্তমান অবস্থাতেই ওভার ব্রিজ বিষয়ে সুপারিশ করেছে। কিন্তু চট্টগ্রামের উন্নয়ন হলে যে দেশের উন্নয়ন হবে এটি অনেকে বুঝতে পারছেন না। আমরা বাধ্য হয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে নালিশ করেছি। উনি শুনে মহাগরম হয়ে গেছেন। আমরা সবশেষ মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিয়েছি। ওই চিঠি অনুমোদনের পর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কাছে যাবে। এরপর চিঠিটি রেলমন্ত্রণালয়ে যাবে। আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে অনুমতি দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করেছে। চুক্তিটি রেলমন্ত্রীর অনুমোদনের অপেক্ষায় আটকে আছে।

সুরাহা হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় কাটারও

পরিবেশের অধিদপ্তরের অনুমোদনের তুলনায় বেশি পাহাড় কাটা ও ৯০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাহাড় কাটায় সিডিএকে ১০ কোটি টাকা জরিমানা গুনতে হয়। এর মধ্যে ২০২০ সালের ২৩ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরে ফের আবেদন করে তিন লাখ ৩২ হাজার ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি চায় সিডিএ। প্রকল্পে আগে কাটা ১৬টি পাহাড় ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার জন্য সিডিএ প্রস্তাবনা চাইলেও পরিবেশ অধিদপ্তর তাতে রাজি হয়নি। পরে প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের আবেদনের প্রেক্ষিতে  সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রকল্প পরিচালক ও চুয়েটের দুই শিক্ষকের সমন্বয়ে চার সদস্যের কমিটি পাহাড়গুলো পরিদর্শন করে। 

তবে চুয়েটের দেওয়া বিশেষজ্ঞ টিমের এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় নতুন করে বিএসআরএম-মেগাফেরি জেভি নামে আরেকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় সিডিএ। ওই প্রতিষ্ঠানটি ঝুঁকিপূর্ণ ১৬ পাহাড় ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার পরামর্শ দেয়।

সর্বশেষ চলতি বছরের ২১ জুন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কমিটি সংশ্লিষ্ট এলাকা পর্যবেক্ষণ করে পরামর্শ দেওয়ার কথা। তবে এ নিয়েও কমিটির তেমন কোনো অগ্রগতি নেই বললেই চলে। ফলে সামান্য বৃষ্টিতেই পাহাড় ধসের কারণে বায়েজিদ লিংক রোডে চলাচল বিঘ্ন ঘটে। হতাহতের ঘটনাও ঘটছে অহরহ। 

 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়