বায়েজিদ লিংক রোডের পাহাড় ধস থামবে কবে?

রকিব কামাল

প্রকাশিত: ২১:৪০, ২৪ জুলাই ২০২২
বায়েজিদ লিংক রোডের পাহাড় ধস থামবে কবে?

পাহাড় ধসে পড়ছে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে।

সড়কে মেয়ের নিথর দেহ। ঘাতক গাড়ির চাকা চলে গেছে মেয়ের মাথার উপর দিয়ে। রাস্তায় তখনো ছোপ ছোপ রক্তের দাগ। কিছুটা দূরেই পড়ে থাকে তাদের মোটরসাইকেলটি। ঘটনার আকস্মিকতায় চিৎকার করে আহাজারি করছিলেন পাগলপ্রায় বাবা। একবার দৌঁড়ে গিয়ে মোটরসাইকেলটি পুড়ে ফেলতে চান। আবার কখনও সড়কে চলা ভারী যানবাহনের সামনে গিয়ে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন।

গেল শনিবার (২৩ জুলাই) দুপুরে চট্টগ্রাম বায়োজিদ লিংক রোডের ৩ নম্বর সেতু এলাকায় এ হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে। ওই মেয়ের বাবার একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসুবকে। তার চিৎকার আর আহাজারিতে আশেপাশের মানুষের চোখেও নেমে আসে জল। সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাটের নিজ বাসা থেকে মেয়ে ফাতেমা জাহানকে কলেজে পৌঁছে দিতে মোটরসাইকেলে করে শহরে আসছিলেন ওমর ফারুক। ফাতেমা নগরের এনায়েত বাজার মহিলা কলেজের দ্বাদশ শ্রেণীর শিক্ষার্থী।

 গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে সড়ক ছিল ভেজা। লিংক রোডের ৩ নম্বর ব্রিজের কাছে আসার পর চাকা পিছলে পড়ে যান বাবা আর মেয়ে। ওমর ফারুক সড়ক বিভাজকের দিকে ছিটকে পড়লেও তার মেয়ে ফাতেমা পড়েন সড়কের মাঝ বরাবর। এ অবস্থায় পেছন থেকে আসা দ্রুতগতির একটি লরি ফাতেমাকে চাপা দিয়ে চলে যায়। লরির চাকায় পৃষ্ট হয়ে রাস্তার সঙ্গে লেপ্টে যায় ফাতেমার মাথা। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তার।

এর আগে গত ২৪ এপ্রিল যাত্রীবাহী বাস উল্টে মোহাম্মদ হোসেন (৫৫) নামে এক পথচারী নিহত হয়েছেন। ঘটনার দিনও বৃষ্টিতে সড়ক ছিল ভেজা। ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ইউনাইটেড ট্রাভেলস পরিবহনের বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ভুক্তভোগীকে চাপা দেয়। এরপর বাসটি বৈদ্যুতিক খুঁটিতে আঘাত করে। 

কেবল ফাতেমা ও মোহাম্মদ হোসেনই নন, গত কয়েক মাসে বায়েজিদ লিংক রোডে বেশ কিছু প্রাণঘাতী দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটেছে। ঘুরে ফিরে এসব ঘটনা ওই সড়কের পাশের পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটির কারণে ঘটছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় বাসিন্দা ও পরিবহন শ্রমিকরা। 

রবিবার (২৪ এপ্রিল) বায়েজিদ বয়েজ ক্লাব নামে একটি সংগঠন বায়েজিদ লিংক রোডের ভারী যানবাহনের বেপরোয়া চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপের প্রতিবাদে মানববন্ধন করেছেন। এসময় কর্মসূচিতে পাহাড় থেকে খসে পড়া মাটির কারণে পিচ্ছিল সড়কে মোটরসাইকেল থাকা বাবা ও মায়ের মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন তারা।

গত ২১ জুন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ে পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় ১৩ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠনের বিষয়টি জানানো হয়। বৈঠকের পর দেড় মাসের বেশি সময় পার হলেও কমিটির কোনো কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এমনকি কমিটির প্রধান এবং কমিটিতে কাদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ বিষয়ে অন্ধকারে রয়ে গেছে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট প্রকল্পের পরিচালক। ফলে সমীক্ষা করে এ প্রকল্পের অধীন ১৬টি পাহাড় ধসে পড়া নিয়ে কার্যত কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়েনি। 

সরেজমিনে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড গিয়ে দেখা যায়, বৃষ্টিতে বায়েজিদ বাইপাস সড়কের ছিন্নমূল বড়ইতলী এলাকায় পাহাড় থেকে ধসে পড়া মাটি সড়কে এসে পড়েছে। ধসে পড়া মাটি ফুটপাত মাড়িয়ে সড়কের ওপর পড়েছে। ঝুঁকি জেনেও সড়কের ধসে পড়া মাটির পাশ দিয়ে ভারী যানবাহন থেকে শুরু করে পথচারীদেরা চলাচল করতে হচ্ছে। প্রশাসনের নজরদারির অভাবে পাহাড়ে বসতি গড়ে উঠেছে। এছাড়াও সড়কের পাশে স্থায়ী-অস্থায়ী দোকানপাট গড়ে ওঠে। ধসের আশঙ্কায় গেল বছরের এপ্রিলে সড়কের একপাশ প্রায় চার মাস বন্ধ ছিল। 

ব্যবসায়ীক কাজে চলাচলের জন্য মো. ফারুক হোসেন নামে এক মোটরসাইকেল চালককে প্রতিদিন বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড ব্যবহার করতে হয়। তিনি সিভয়েসকে বলেন, নগরের যানবাহনের ওপর চাপ কমাতে এই সড়কটি করা হয়েছে। অথচ এখানে কোনো গতি প্রতিরোধক না থাকায় মোটরসাইকেল থেকে শুরু করে ভারী যানবাহনগুলো দ্রুত গতিতে গাড়ি চালায়। কোনো কারণে নিয়ন্ত্রণ হারালে দুর্ঘটনায় অনেকে মারা যান। বৃষ্টিতে ধসে পড়া মাটি পিচ্ছিল হয়ে যাওয়ায় ভারী যানবাহনগুলো ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করে। 

সাইদুল নামে এক লরি চালক সিভয়েসকে বলেন, গভীর রাতে মালামাল নিয়ে সড়ক দিয়ে চলাচল করতে হয়। অনেক সময় অন্ধকারে গাড়ির সামনের অংশ দেখা যায় না। সড়কটি ভালোর জন্য করতে গিয়ে এখন দুর্ঘটনায় অনেকে মারা যাচ্ছেন। সড়কের পাশের পাহাড় থেকে মাটি পড়লেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।  

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, মূলত চট্টগ্রাম শহরের যানজটের ওপর চাপ কমাতেই মূল শহরের প্রবেশদ্বারের সঙ্গে সংযুক্ত করে বাইপাস সড়ক করার উদ্যোগ নেয় সিডিএ। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ১৯৯৭ সালে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের সীতাকুণ্ডের ফৌজদারহাট টোল রোডের মুখ থেকে বায়েজিদ বোস্তামি পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। ওই সময়ের ৩৩ কোটি ৮১ লাখ টাকার প্রকল্পটি শেষ হয় ৩২০ কোটি টাকায়। প্রকল্পের জন্য ৯২০ কাঠা জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০১৯ সালের ১২ মে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রকল্পটির জন্য পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়। প্রকল্পের আওতায় একটি রেলওয়ে ওভারব্রিজসহ ছয়টি ব্রিজ এবং কয়েকটি কালভার্ট নির্মাণ করা হয়। প্রকল্পের ৬ কিলোমিটার রাস্তা নির্মাণে কাটা হয় ১৬টি পাহাড়। 

পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র অনুযায়ী প্রকল্পের জন্য আড়াই লাখ ঘনফুট পাহাড় কাটার অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বাস্তবায়নকারী সংস্থা সিডিএ ১০ লাখ ৩০ হাজার ঘনফুট পাহাড় কেটেছে বলে অভিযোগ করে পরিবেশ অধিদপ্তর। এ বিষয়ে সিডিএকে নোটিশ দিয়ে ২০২০ সালের ২৯ জানুয়ারি শুনানিতে তলব করে পরিবেশ অধিদপ্তর। শুনানিতে সিডিএকে ১০ কোটি ৩৮ লাখ ২৯ হাজার ৫৫৩ টাকা জরিমানা করা হয়। 

অপরদিকে ঝুঁকিপূর্ণ খাঁড়া পাহাড়গুলো নতুন করে কাটার জন্য ২০২০ সালের ২৩ মার্চ পরিবেশ অধিদপ্তরে ফের আবেদন করে তিন লাখ ৩২ হাজার ঘনমিটার পাহাড় কাটার অনুমতি চায় সিডিএ। প্রকল্পে আগে কাটা ১৬টি পাহাড় ২২ দশমিক ৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার জন্য সিডিএ প্রস্তাবনা চাইলেও পরিবেশ অধিদপ্তর তাতে গরজ করেনি। তবে আবেদেনের প্রেক্ষিতে সিডিএ’র প্রধান প্রকৌশলীর নেতৃত্বে প্রকল্প পরিচালক ও চুয়েটের দুই শিক্ষকের সমন্বয়ে চার সদস্যের কমিটি পাহাড়গুলো পরিদর্শন করে। 

তবে চুয়েটের দেওয়া বিশেষজ্ঞ টিমের এ ধরনের কাজের পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় নতুন করে বিএসআরএম-মেগাফেরি জেভি নামে আরেকটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানকে কনসালট্যান্ট হিসেবে নিয়োগ দেয় সিডিএ। ওই প্রতিষ্ঠানটি ঝুঁকিপূর্ণ ১৬ পাহাড় ৬০ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার পরামর্শ দেয়।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে  বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোড প্রকল্পের পরিচালক আসাদ বিন আনোয়ার সিভয়েসকে বলেন, চুয়েট ও চবির বিশেষজ্ঞ টিমের সদস্যদের পরিদর্শনের পর বিএসআরএম-মেগাফেরি জেভি নামে আরও একটি পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রতিবেদন দিয়েছেন। তারা ৬০ ডিগ্রি বললেও আমরা ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে পাহাড় কাটার বিষয়ে অনুমতি চেয়েছিলাম। তবে সর্বশেষ পাহাড় ব্যবস্থাপনা কমিটিতে সবগুলো সংস্থাকে যুক্ত করে ১৩ সদস্যবিশিষ্টি কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটির চিঠি না পাওয়ায় এখনই কিছু বলতে পারছি না। কমিটিতে যাদের রাখা হয়েছে তাদের পরামর্শের ভিত্তিতে পাহাড়গুলো কাটার বিষয়ে সিদ্ধান্তে যাওয়া যাবে।

বিভাগীয় কমিশনারের দপ্তর থেকে কমিটির কথা বলা হলেও কমিটির প্রধান কাকে করা হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি প্রকল্প পরিচালক। এমনকি সিডিএর প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামসকে ফোন করেও পাওয়া যায়নি। 

এক প্রশ্নের জবাবে আসাদ বিন আনোয়ার বলেন, পাহাড়গুলো ৪৫ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে কাটার বিষয়ে আমরা ডিজাইন করেছি। কমিটিতে সব সংস্থাকে রাখা হয়েছে। কমিটি ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়গুলো সরাসরি পরিদর্শনে যাবে। পাহাড় কাটা নিয়ে যেহেতু পরিবেশ অধিদপ্তরের আপত্তি তাদের সঙ্গেও বসতে হবে। এ কারণেই পাহাড় কাটার বিষয়টি আটকে আছে। আশা করছি বৈঠকে যাবতীয় বিষয়গুলো উঠে আসবে।

এদিকে এই প্রকল্পের আওতায় রেলওয়ে ওভারব্রিজের কাজটিও দ্রুত শুরু করা সম্ভব হবে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

সিভয়েস/এএস

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়