Cvoice24.com

বিটুমিন সংকটে ‘বন্ধ’ চট্টগ্রামের তিনশ সড়কের উন্নয়ন কাজ

তারেক মাহমুদ

প্রকাশিত: ১৯:২৯, ৬ ডিসেম্বর ২০২২
বিটুমিন সংকটে ‘বন্ধ’ চট্টগ্রামের তিনশ সড়কের উন্নয়ন কাজ

প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বাঁশখালীর গণ্ডামারা ব্রিজ থেকে গণ্ডামারা কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র পর্যন্ত সড়ক উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ করছে এলজিইডি। সড়কটি উন্নয়নের বাকি সব কাজ শেষ হলেও থমকে গেছে কার্পেটিংয়ের কাজে। বিটুমিনের অভাবে সড়কটিতে কার্পেটিংয়ের কাজ আটকে আছে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের অধীনে এরকম প্রায় ৩শ’টিরও বেশি প্রকল্পের কাজ বন্ধ। নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় লোকসান এড়াতে প্রকল্পের রেট শিডিউল বাড়ানোর অপেক্ষায় আছেন চট্টগ্রামের ১৮শ ঠিকাদার। 

ঠিকাদাররা বলছেন, ডলারের দাম বাড়ার কারণে পাথর ও বিটুমিনের দাম বেড়ে গেছে। রিফাইনারী থেকেও বিটুমিনের সরবরাহ কম। প্রতিটন বিটুমিন ৪৮ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকায় ঠেকেছে। তাই প্রকল্পের আওতাধীন বিভিন্ন সড়কের কার্পেটিংয়ের কাজে স্থবিরতা নেমে এসেছে। পাশাপাশি নির্মাণসামগ্রী যেমন ইট, বালু, পাথর, রড, সিমেন্ট, রেডি মিক্স, বিটুমিন এবং লোহাজাতীয় সব জিনিসের দাম বাড়ার কারণে সংকট আরও বেড়েছে। সরকার চলতি বছরের নির্মাণ উপকরণের যে রেট প্রকাশ করেছে, বাজারমূল্য এর চেয়েও বেশি। বর্তমানে চট্টগ্রামের ঠিকাদাররা যে প্রকল্পগুলো নিয়ে কাজ করছেন তার অধিকাংশই ২০১৮ সালের রেট শিডিউল অনুযায়ী। পাঁচ বছর আগে নির্মাণসামগ্রীর যে দাম ছিল বর্তমানে তা আর নেই। ফলে প্রকল্পের কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। 

ঠিকাদারদের তথ্যমতে, চট্টগ্রাম জেলার বাঁশখালী উপজেলায় প্রায় ২৪ কোটি টাকা ব্যয়ে গন্ডামারা ব্রীজ হতে গন্ডমারা বিদ্যুৎ কেন্দ্র সংযোগ সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, প্রায় ৫৩ কোটি টাকা ব্যয়ে পটিয়া উপজেলার বিভিন্ন সড়ক উন্নয়ন প্রকল্প, ৩৩ কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের সংযোগ সড়ক উ্নয়ন প্রকল্পের কাজ থমকে আছে। তাছাড়া চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার শাকপুরা চৌমুহনী এলাকায় আড়াই কিলোমিটার দূরত্বের একটি সড়কের কাজ চলমান রয়েছে। বাঁশখালী উপজেলার মিয়াবাজার এলাকায় সাড়ে তিন কিলোমিটার ও চন্দনাইশের সামাদ্রিয়া খালের উপর ৩৫ মিটার ব্রিজের নির্মাণ কাজ চলছে। এ প্রকল্পগুলো এলজিইডি বাস্তবায়ন করছে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের অধীনে খাজা রোডে এক কিলোমিটার দূরত্বের সড়কের কাজ চলছে। সবগুলো কাজই বিটুমিনের অভাবে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে।

জানা গেছে, চট্টগ্রামে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) উৎপাদিত বিটুমিনের চাহিদা বেশি। সরকারি সড়ক অবকাঠামোর উন্নয়ন, রক্ষণাবেক্ষণে আগে থেকেই অপরিহার্যভাবে বিপিসির উৎপাদিত বিটুমিন ব্যবহার হয়ে আসছে। বিপিসির মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইস্টার্ন রিফাইনারিতে ৬০ থেকে ৭০ ও ৮০ থেকে ১০০ গ্রেডের বিটুমিন উৎপাদিত হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিটুমিনের সরবরাহ কমে যাওয়া ও দাম বেড়ে যাওয়ায় রাস্তার কার্পেটিংয়ের কাজ এগিয়ে নিতে পারছেন না ঠিকাদাররা। 

এ বিষয়ে জানতে ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. লোকমান সিভয়েসকে বলেন, আমরা তো ক্রুড অয়েল থেকে বিটুমিনটা বানাই। আমাদের প্ল্যান্টটাও চালু আছে। সত্যি বলতে বিটুমিনের আমাদের দেশিয় অভ্যন্তরীন যে চাহিদা আছে তা আমরা মেটাতে হিমশিম খাচ্ছি। বছরে প্রায় ৬ লাখ মেট্রিকটনের মত বিটুমিনের চাহিদা রয়েছে। এর বিপরীতে আমরা মাত্র ৭২ হাজার মেট্রিকটন বিটুমিনের যোগান দিতে পারি। তাই প্রকল্পের কাজ পরিচালনায়ও সমস্যা তৈরি হচ্ছে।

নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়ায় বন্ধ ৬৫ ভাগ কাজ

দীর্ঘদিন ধরেই অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করছে নির্মাণ সামগ্রীর বাজারে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বাড়তি পরিবহন খরচ, ও রডের কাঁচামাল আমদানিতে ডলার সংকটের কারণে নির্মাণসামগ্রীর দাম ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে একেবারে ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে গেছে। বিশেষ করে রডের দাম আকাশছোঁয়া। বর্তমানে চট্টগ্রামে এলজিইডির অধীনে প্রায় ৬শ প্রকল্পের কাজ চলছে। তাছাড়া শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক ও জনপথ বিভাগ, গৃহায়ণ ও গণপূর্ত বিভাগ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের আরও প্রায় সাড়ে ৫শ প্রকল্পের কাজ চলমান আছে। চট্টগ্রামে প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার এসব প্রকল্পের কাজ সামলাতে জড়িত আছেন অন্তত ১৮শ ঠিকাদার। তবে নির্মাণসামগ্রীর অস্বাভাবিক দাম বাড়ার কারণে লোকসানের ভয়ে চট্টগ্রামে চলমান প্রায় ৬৫ ভাগ প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেছে ঠিকাদাররা।  

নির্মাণসামগ্রীর দাম জানতে বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) নগরের বিভিন্ন দোকান ঘুরে দেখা গেছে, বছরের শুরুতে প্রতি ব্যাগ সিমেন্ট ৪শ টাকায় বিক্রি হলেও বছরের শেষে এসে বিক্রি হচ্ছে সাড়ে ৫শ টাকায়। রডের দাম ৬৫ হাজার থেকে বেড়ে ৯২ হাজার ও প্রতিটন বিটুমিন ৪৮ হাজার থেকে বেড়ে ৮৫ হাজার টাকায় ঠেকেছে। এক বছর আগে ৮০ টাকার ডিজেল এখন ১০৯ টাকায়, ইটের গাড়ি ৪ হাজার টাকা বেড়ে ১২ হাজার ৫শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তাছাড়া রেডিমিক্স, পাথর এবং শ্রমিকের মজুরিও বেড়েছে। 

রড প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান কেএসআরএমের ডিরেক্টর (করপোরেট) সামশুল হক সিভয়েসকে বলেন, বিশ্ববাজারে রড তৈরির প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের দাম বাড়তি। তার উপর ডলার সংকটের কারণে কাঁচামাল আমদানিতে এলসি খুলতে সমস্যা হচ্ছে। তাই আমরা পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রেও নানাভাবে প্রভাবিত হচ্ছি। কবে এ শঙ্কা কাটবে তাও বলা যাচ্ছে না।

রেট শিডিউল বাড়ানোর অপেক্ষায় ঠিকাদাররা 

নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় নির্মাণ খরচ প্রায় ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের পাশাপাশি ব্যক্তিপর্যায়েও নির্মাণকাজ থমকে গেছে। লোকসানের ঝুঁকি থাকায় সরকারি অনেক প্রকল্পে কাজ বন্ধ রেখেছেন ঠিকাদাররা। সরকারি প্রকল্পের কাজগুলোতে ধীরগতি নেমে এসেছে। ফলে রেট শিডিউল বাড়ানোর অপেক্ষায় আছেন ঠিকাদাররা।

চট্টগ্রাম এলজিইডি ঠিকাদার সমিতির সভাপতি মহিউদ্দীন সেফুল সিভয়েসকে বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রামে সরকারের প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন কাজ চলমান আছে। তবে কাজের গতি একদম কমে গেছে। যেহেতু বৃষ্টি নেই, এখন পুরোদমে আমাদের কাজ চলার কথা। যেখানে এখন ৯০ শতাংশ কাজ চলার কথা সেখানে এখন ৬৫ শতাংশ প্রকল্পের কাজ বন্ধ হয় গেছে। টনপ্রতি ৫০ হাজার টাকায় বিক্রি হওয়া রড এখন ৯২ হাজার টাকার উপরে। তার উপর আমরা বিটুমিন পাচ্ছি না। ডলারের দাম বাড়ার কারণে পাথরের দামও বেড়েছে। ফলে রাস্তার কার্পেটিংয়ের কাজও বন্ধ আছে। নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় প্রকল্পের কাজ পরিচালনা করতে গিয়ে আমরাও লোকসানন আতঙ্কে আছি। তাই আমরা প্রকল্পের রেট শিডিউল বাড়ানোর অপেক্ষায় আছি। 

এলজিইডি চট্টগ্রাম জেলার নির্বাহী প্রকৌশলীর কার্যালয়ের নির্বাহী প্রকৌশলী এ কে এম আমিরুজ্জামান সিভয়েসকে বলেন, নির্মাণসামগ্রীর দাম তো আসলে অনেক বেড়ে গেছে। এ কারণে প্রকল্পের কাজে ভাটা পড়েছে। সত্যি বলতে ঠিকাদাররাও ব্যয় সামলাতে পারছেন না। রড, পাথর সবকিছুর দাম কয়েক গুণ বেড়েছে। আমরা তো এ দেশের মানুষ। তাই আমাদেরকে একটু সহনশীল হয়ে পরিস্থিতি মোকাবলা করতে হবে। আশা করি সামনে নির্মাণসামগ্রীর দাম কমে আসবে। তখন প্রকল্পের কাজে গতি আসবে।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরশেনের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলামের মুঠোফোনে একাধিকবার কল দিলেও তিনি রিসিভ করেননি।

সংকটে আবাসন খাতও

রড, সিমেন্টসহ অন্যান্য নির্মাণসামগ্রীর দাম বাড়ায় চট্টগ্রামের আবাসন খাতও মুখ থুবড়ে পড়েছে। অনেকেই প্রকল্পের কাজ বন্ধ রেখেছেন। আবার কেউ খুব ধীর গতিতে কাজ চালিয়ে নিচ্ছেন। অপরদিকে বাজার স্থিতিশীল হওয়ার নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত অনেকে নতুন করে প্রকল্প নেওয়া স্থগিত রেখেছেন।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (রিহ্যাব) চট্টগ্রাম অঞ্চলের সভাপতি আবদুল কৈয়্যুম চৌধুরী সিভয়েসকে বলেন, নির্মাণ ব্যয় এখন ৩০ থেকে ৪০ শতাংশ বেড়ে গেছে। যেসব ক্রেতাদের কাছ থেকে আগাম টাকা নিয়েছি সে প্রকল্পগুলো আমাদের বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে। আমরা আবাসন খাতের ব্যবসায়ীরা নতুন করে প্রকল্প নেওয়ার সাহস পাচ্ছি না। আগামী সময়গুলো কিভাবে যাবে আমরা তা নিয়ে শঙ্কিত।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়