Cvoice24.com

সরকারি তথ্যে লুকোচুরি/
চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মরছে মানুষ, তালিকায় উঠছে না!

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২২:২৩, ৩১ অক্টোবর ২০২২
চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মরছে মানুষ, তালিকায় উঠছে না!

মুন্না ও সীমা আপন দুই ভাইবোন। সীমা ২০ বছরের তরুণী আর মুন্না ১৭ বছরের। হালিশহর টিজি কলোনি এলাকায় ছিল তাদের বসবাস। গত ২৮ অক্টোবর হঠাৎ জ্বরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যান সীমা। ওইদিনই চট্টগ্রামের মা ও শিশু হাসপাতালে ভর্তি করানো হয় মুন্নাকে। পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানা গেল মুন্না ডেঙ্গুতে আক্রান্ত। কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে ডেঙ্গুর মরণ থাবায় হারিয়ে যায় কিশোর মুন্নাও। সীমার ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়নি তার মৃত্যুর কারণ জানা যায়নি। তবে স্থানীয় কাউন্সিলরের দাবি— মুন্নার মতো সীমারও মৃত্যু ডেঙ্গুতে হয়েছে। 

এদিকে এ ঘটনার ঠিক একদিন পর গতকাল ৩০ অক্টোবর জামালখানের লাভলেন এলাকার আবেদিন কলোনিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান আরেকজন। পরপর দুদিন চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে তিনজনের মৃত্যু হলেও সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত প্রতিদিনের ডেঙ্গুর রির্পোটে মৃত্যুর ঘর ছিলো ‘শুন্য’। এমনকি এ বিষয়েও ‘অবগত নয়’ বলেও জানিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

চট্টগ্রামের নগর ও উপজেলার ডেঙ্গু রোগীদের পরিসংখ্যান তৈরির দায়িত্ব সিভিল সার্জন কার্যালয়ের। অথচ সিভিল সার্জন কার্যালয় থেকে প্রকাশিত ডেঙ্গুর প্রতিবেদনে মৃত্যুর হিসাবে এমন ‘নয়ছয়’ হওয়াতে আক্রান্তের তথ্যের সত্যতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। কারণ এর আগেও তিন দফা ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির নাম ঘটনার দুই থেকে তিনদিন পর প্রকাশ করে কর্তৃপক্ষ। 

এদিকে, চট্টগ্রাম নগর ও উপজেলার ডেঙ্গু রোগের দৈনন্দিন প্রতিবেদন সংগ্রহ করে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পাঁচ সদস্যের একটি টিম। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল থেকে ভর্তি বা শনাক্তকৃত রোগীদের তথ্য পাঠানো হয় ইমেইলে। সেখান থেকেই আলাদা পরিসংখ্যান তৈরি করে ডেঙ্গুর মোট তথ্য প্রকাশ করে সিভিল সার্জন কার্যালয়।

সিভিল সার্জন কার্যালয়ের প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, গত তিন দিনে ১৯১ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং এ তিনদিনে কারও মৃত্যুর তথ্য প্রকাশিত হয়নি। অথচ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ তিন মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ  আবদুল মান্নান ও ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শাহেদ ইকবাল (বাবু)। 

এ বিষয়ে গতকাল (৩০ অক্টোবর) চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন ২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. শাহেদ ইকবাল (বাবু) সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট দেন। এ বিষয়ে তার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের কাউন্সিলরদের গ্রুপ আছে সেখানেই এই তথ্য পাই। সেখান থেকেই নিয়ে আমি আমার এলাকাবাসীদের সতর্ক করার জন্য পোস্ট দিয়েছি।’

এবার কাউন্সিলরের দেওয়া সেই পোস্টের সূত্র ধরে সত্যতা জানতে চেয়ে কথা হয় ৩৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের সঙ্গে। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘মুন্না ও সীমা নামের দুই ভাইবোন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে একদিন আগে পরে করে মারা যান। তারমধ্যে সীমাকে হাসপাতালে নেওয়ার আগেই মারা যায়। তাই তার ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়নি। তবে মুন্নার ডেঙ্গু পরীক্ষা হয়েছিল। মুন্না ডেঙ্গুতেই মারা গেছে। মুন্নার মতো সীমারও একই অবস্থা হয়েছে। তাই ধারণা করছি সীমাও ডেঙ্গুতে মারা গেছে। এছাড়া আবেদিন কলোনিতেও একজন ডেঙ্গুতে মারা গেছে বলে আমরা জেনেছি।’

দুই সহোদরের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের প্রধান পরিচ্ছন্ন কর্মকর্তা ও মেয়রের একান্ত সচিব মোহাম্মদ আবুল হাশেমও। তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘এ ঘটনা সত্য। টিজি কলোনি এলাকায় একই পরিবারের দুইভাইবোন মারা যায়। তারমধ্যে একজনের ডেঙ্গু পরীক্ষার আগে মারা যায়। অন্যজন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। আরেকজন গতকাল আবেদিন কলোনিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মারা যান। আমাদের স্থানীয় কাউন্সিলররাই এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।’

এদিকে, সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তালিকা অনুযায়ী চলতি বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে চট্টগ্রামে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরমধ্যে পুরুষ তিনজন, নারী সাতজন এবং শিশু চারজন। তারমধ্যে ২৮ সেপ্টেম্বর মিজানুর রহমান নামের একজন নগরের বেসরকারি হাসপাতাল মেডিকেল সেন্টারে মারা গেছেন। অথচ এই রোগীর মৃত্যুর তথ্য সিভিল সার্জন কার্যালয় প্রকাশ করে ৩০ সেপ্টেম্বর।

একইভাবে ৫ অক্টোবর ডেঙ্গুতে মারা যাওয়া রুবি আক্তার নামের আরেক রোগীর মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে দুইদিন পর ৭ অক্টোবর। সর্বশেষ ১৩ অক্টোবর নুসরাত নামের নয় মাস বয়সী এক শিশু মারা গেলেও তার মৃত্যুর তথ্য প্রকাশ করে ১৫ অক্টোবর। যদিও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের দাবি— হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ থেকে দেরিতে তথ্য পাওয়ায় এমনটা ঘটেছে।

প্রকাশিত প্রতিবেদনে কেন এই তিন মৃত্যুর তথ্য লিপিবদ্ধ হয়নি সেই বিষয়ে সিভিল সার্জন কার্যালয়ের কীটতত্ত্ববিদ ও দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এনতেজার ফেরদৌসের কাছে জানতে চাইলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘প্রতিদিন যাতে আমাদেরকে ডেঙ্গুর রিপোর্ট দেয় সেটার জন্য হাসপাতালগুলোকে আমরা বারবার তাগাদা দেই। তারপরেও দেখা যায় অনেক সময় তারা তথ্য দিতে দেরি করে। আমাদের বলা হয়েছে, যেসকল হাসপাতাল ডেঙ্গুর দৈনন্দিন তথ্য দিবে না তাদের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। আমরা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন নোটিশ তাদেরকে চিঠি আকারে পাঠাই সেসবও তারা খুব একটা গুরুত্ব দেয় না। দেখা যায় অধিকাংশ সময় আমাদের বারবার ফোন করে তথ্য নেওয়া লাগে।’

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য আসেনি। কারণ আমাদের তথ্য পাঠালে সেই তথ্যই আমরা প্রকাশ করি। দুইটা ঘটনার ক্ষেত্রে মৃত্যুর তথ্য আমাদেরকে দেরিতে জানিয়েছিল তাই আমাদেরও দেরিতে জানাতে হয়েছে। এই বিষয়ে আমাদের কাছে কোনো তথ্য আসেনি। তাও আমরা খবর নিবো কেন জানায় নি।’ 

ডেঙ্গুর তথ্য নিয়ে লুকোচুরির কথা উল্লেখ করে মোহরা এলাকার বাসিন্দা আসাদুজ্জামান  সিভয়েসকে বলেন, ‘ঘরে ঘরে এখন জ্বর সর্দি কাশি। এরমধ্যে কেউ পরীক্ষা করছে, কেউ করছে না। যদি সঠিকভাবে ডেঙ্গুর প্রকৃত তথ্য পাওয়া যেত৷ তখন দেখা যেত স্বাস্থ্য বিভাগের তালিকার চেয়েও কয়েকগুণ বেশি রোগী আছে। এখানে তথ্যের একটা ভূমিকা আছে। যেহেতু প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না সেক্ষেত্রে সিটি করপোরেশনও কিন্তু অতটা গুরুত্ব দিচ্ছে না। মাঝখানে আমাদের জীবন ঝুঁকির মুখে।’ 

ডেঙ্গুতে মৃত ব্যক্তির নাম তালিকায় না আসার কারণ প্রসঙ্গে চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াছ চৌধুরী বলেন, ‘আমাদেরকে তথ্য না দিলে তো আমরা তালিকায় তুলতে পারবো না। বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে তথ্য দিলে তারপরই আমরা তালিকা প্রকাশ করি। ওইসব হাসপাতালে তো আমাদের কোনো ডাক্তার নেই। হাসপাতালগুলোকে বলা আছে তারা ডেঙ্গুর প্রতিবেদন পাঠাবে নাহলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এখন তারা যে তথ্য দেয় সেটাই আমরা প্রকাশ করি। আমাদেরকে কখন কে কোন তথ্য পাঠিয়েছে সবই আছে।’

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের তথ্য ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. মাইদুল ইসলাম প্রধান সিভয়েসকে বলেন, ‘প্রতিদিনকার তথ্য প্রতিদিনই প্রকাশ করা উচিত। তবে নানান কারণে এক দুইদিন দেরিতে হতে পারে সেটা স্বাভাবিক। তারপরেও কেন তালিকায় উঠলো না সে বিষয়টা খতিয়ে দেখা হবে।’

প্রসঙ্গত, চট্টগ্রামে লাগামহীন ভাবে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ। চলতি বছরেই আক্রান্ত হয়েছে আড়াই হাজারের বেশি মানুষ। শুধুমাত্র গত এক মাসেই আক্রান্ত হয়েছে সাড়ে ১৮শ জন। মাসের ব্যবধানে যা সংখ্যায় পাঁচ গুণ। আর মশক নিধনে সিটি করপোরেশনের কার্যকর ভূমিকা না থাকায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে বলে দাবি নগরবাসীর।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়