Cvoice24.com

শঙ্কায় ভর দিয়ে এক বছরে যা দেখেছে চট্টগ্রাম

আসিফ পিনন, সিভয়েস

প্রকাশিত: ০০:৫২, ৩ এপ্রিল ২০২১
শঙ্কায় ভর দিয়ে এক বছরে যা দেখেছে চট্টগ্রাম

সময়টা ২০২০ সালের ৩ এপ্রিল। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগের ওই সময়ে চট্টগ্রামে প্রথম করোনার জীবাণু পাওয়া যায় নগরের দামপাড়া এলাকার এক বাসিন্দার। সেই যে শুরু, দিন দিন বাড়তে থাকে শনাক্তের হার। এক সময় ছড়িয়ে পড়ে পুরো নগরেই। সরকারি হিসাবে এ পর্যন্ত চট্টগ্রামে করোনা ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে ৩৮৯টি প্রাণ। আক্রান্ত হয়েছেন ৪০ হাজার ৮০১ জন। 

দেশে প্রথম করোনা ভাইরাস আক্রান্ত রোগী সনাক্ত হয় গেল বছরের ৮ মার্চ। ওই সময়ে করোনা ঠেকাতে চট্টগ্রামসহ পুরোদেশ লকডাউন ঘোষণা করে সরকার, যা কার্যকর হয়েছিল ২৭ মার্চ থেকে। পরে সেপ্টেম্বর থেকে সংক্রমণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এলে ‘নিউ নরমাল লাইফ’ শুরু করে নগরবাসী। তবে করোনার প্রথমে ঢেউয়ের পৃথিবী দেখেছে মৃত্যুর মিছিল। বিভৎসতা আর শ্বাসকষ্টের নির্মম পরিনতি। 

হৃদয়বিদারক হলেও সত্যি, নিজের পরিবারের সদস্যরাও দূরে ঠেলে দিয়েছিল করোনা আক্রান্তদের। আর মৃত্যু হলে তো কথাই নেই। বাড়িটিকেই এড়িয়ে চলতো লোকজন। বাবা-মায়ের লাশ ফেলে সন্তান, আবার সন্তানের লাশ ফেলে বাবাকেও হাসপাতাল থেকে পালিয়ে যেতে দেখা গেছে।     

করোনাকালের সেই ভয় মাড়িয়ে চট্টগ্রামকে অবশ্য পথ দেখিয়েছে চিকিৎসক, সেচ্ছাসেবী সংগঠন, নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী, পুলিশ, প্রশাসন আর কিছু স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণী।

করোনায় যেন এক অন্য রকম পুলিশ 
অভিযোগের কমতি নেই পুলিশের বিরুদ্ধে। কখনও  অভিযোগ— কারণ ছাড়াই থানায় নিয়ে আটকে রাখার। কখনও আবার স্বেচ্ছাচারীতার। কিন্তু করোনাকালে চট্টগ্রাম দেখেছে এক অন্যরকম মানবিক পুলিশকে। জীবনের ঝুঁকি নিয়েই পথে, অলিগলিজুড়ে টহল দিয়েছেন পুলিশ সদস্যরা। সরকারের দূরত্ব বিধি আর করোনা ঠেকানোর শত নিয়ম বাস্তবায়নে ফ্রন্ট লাইনে ছিল চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশ (সিএমপি)। কারও ঘরে খাবার ফুরিয়ে গেলে পৌঁছে দিয়েছে খাদ্য। একটি ফোন কল পেলে মানুষের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়েও ছুটে গেছে দোর গোড়ায়। লকডাউনের সময়ে ভরসা দিয়ে বার বার পুলিশ বলেছিল— ‘ঘরে থাকুন। আপনার যা প্রয়োজন আমরা পৌঁছে দেব।’ মানুষ শুনেছেও তাদের কথা। মেনেই চলেছে সব নিয়ম। 

এছাড়াও বিদেশফেরতদের কোয়ারেন্টিন নিশ্চিত করা, রোগীদের আইসোলেশনে পাঠানো, মুমূর্ষু রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স সহায়ত, গর্ভবতী মাকে হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়া, চিকিৎসার কাজে নিয়োজিত চিকিৎসক কিংবা অন্যদেরও বাসা থেকে কর্মস্থলে পৌঁছে দেওয়া, কিংবা টেলিমেডিসিন সেবা— সবকিছুই করেছে পুলিশ। মানবতার সেবার সবটুকু করতে গিয়ে আক্রান্তও হয়েছেন অনেকেই। বরণ করতে হয়েছে করুন মৃত্যুও।

করোনায় সিএমপির অন্যতম উদ্যেগ ‘করোনা ভাইরাস রেসপন্স টিম’। মরণঘাতীতে আক্রান্ত কিংবা কারও মৃত্যু হলে তাৎক্ষণিক নিজেদের বাহিনী নিয়ে ছুটে যেতেন টিমের সদস্যরা।

সংক্রমণ ঠেকাতে মাঠে প্রশাসন
কেউ মানছে, কেউ মানছে না দূরত্ব বিধি। বাসা থেকে বের হয়ে কেউ আবার মাস্কই পরছেন না। মহামারি ঠেকানোর মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ডস্যনিটাইজারসহ যত সরঞ্জাম; সবকিছু নিয়েই হচ্ছে ‘দুই নম্বরি’। এমন পরিস্থিতিতে চট্টগ্রামে কঠোরভাবে মাঠে নামে চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন। মাস্ক ছাড়া বাইরে বের হলে শুরু হয় জরিমানা। নকল মাস্ক, পিপিই, হ্যান্ডস্যানিটাইজার পেলেই নামে শাস্তির খড়্গ। 

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, মহানগরের ছয় সার্কেলের এসি-ল্যান্ড ও ৩৬ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নগরীতে করোনাকালীন দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়াও উপজেলা পর্যায়ে মাঠে ছিলেন ১৫ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা।  

করোনার ভয়ে যখন মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছিল না। তখন করোন ঠেকাতে দিন-রাত মাঠে ছিল প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তা থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও। মানুষের সেবা নিশ্চিত করতে গিয়ে স্বপরিবারে আক্রান্ত হয়েছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও কাট্টলী সার্কেলের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ তৌহিদুল ইসলাম। সস্ত্রীক করোনার কবলে পড়েছিলেন চট্টগ্রাম তৎকালীন বিভাগী কমিশনার এবিএম আজাদ, জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ ইলিয়াস হোসেনসহ আরও অনেকেই।

পাশে কেউ নেই, শেষযাত্রায় কেবল তারা
করোনার পাশাপাশি শঙ্কা বাড়িয়েছিল উপসর্গের মৃত্যুও। ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় লাশের পাশে যেতো না আত্মীয়-স্বজনরাও। এ পরিস্থিতিতে মৃতকে দাফন কিংবা সৎকারে এগিয়ে আসে কিছু সামাজিক ও স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন। চট্টগ্রামে মরদেহ দাফনে নিয়োজিত অন্যতম চার সংগঠন হলো— আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন, এসআইপিএফ মুর্দাসেবা প্রকল্প, গাউসিয়া কমিটি বাংলাদেশ ও করোনা মৃতদেহ স্বেচ্ছাসেবক সংঘ। 

গাউসিয়া ও আল মানাহিল ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশন গেল বছরে শুধুমাত্র চট্টগ্রামেই দাফন ও সৎকার করেছে তিন হাজার মৃত ব্যক্তিকে। এদের মধ্যে কেউ কেউ করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করলেও; বেশিরভাগই ছিল করোনার উপসর্গ, হার্ট অ্যাটাক, কিডনিজনিত সমস্যাসহ বিভিন্ন রোগে মৃত।
 
লাশ দাফন ছাড়াও করোনার প্রথম ঢেউয়ের সময়ে লাকডাউনের সঙ্গে সঙ্গে বাসায় খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার কাজ করেছে অনেকগুলো সংগঠন। আতঙ্কের মধ্যেই বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা, ফ্রি অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস, অক্সিজেন সিলিন্ডার পৌঁছে দেওয়াসহ মানবিক কাজে এগিয়ে এসে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন স্বেচ্ছাসেবীরা।

আঁধারে পথ দেখায় তারুণ্য
লকডাউনে তখন ফাঁকা শহর। নগরের বুকে নেমে এসেছে ঘোর আঁধার। করোনা এড়াতে অনেকেই মেনে চলছে সব বিধি। আবার সব ভয়ভীতির তোয়াক্কা না করে কেউ কেউ বের হন জীবনের চাকা ঘোরাতে। নানা ঘাত-প্রতিঘাতে বাড়তে থাকে করোনার চোখ রাঙানি। 

এমন বিপদের মুখোমুখেই নগরের স্বপ্নবাজ তরুণরা নিজেদের অর্থ ও শ্রমে গড়ে তুলেছিল অন্তত নয়টি আইশোলেশন সেন্টার। এদের মধ্যে দ্যুতি ছড়িয়েছে হালিশহর এলাকায় গড়ে ওঠা ১০০ শয্যার আইসোলেশন সেন্টারটি। তাছাড়া নগরের আগ্রাবাদ, চান্দগাঁও, বহদ্দারহাটসহ বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা আইসোলেশন সেন্টারগুলো মানুষের বিপদের দিনে পাশে দাঁড়িয়েছিল।

এসব আইসোলেশন সেন্টারে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি ফ্রিতে মানুষের বাসায় পৌঁছে দেওয়া হতো অক্সিজেন সিলিন্ডার, খাবারসামগ্রী আর জরুরি ওষুধপত্র। তাদের দেখাদেখি বিভিন্ন পাড়া-মহল্লাগুলোতেও ব্যক্তিগত উদ্যোগে দু-চারটি বেড নিয়ে হলেও অনেকেই গড়ে তুলেছিলেন আইসোলেশন সেন্টার।

মৃত্যুর মিছিলে চিকিৎসকরা
চট্টগ্রামে করোনায় প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছিল গত বছরের ১১ এপ্রিল। এরপর চলে গেছেন আরও অনেকেই। প্রথমবারের মত ওই বছরের ২৫ মে করোনায় প্রাণ হারান চট্টগ্রাম মা ও শিশু হাসপাতালের মেডিক্যাল অফিসার ডা. এসএম জাফর হোসাইন রুমি, ৩ জুন মারা যান চট্টগ্রাম মেরিন সিটি মেডিক্যাল কলেজের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এহসানুল করিম, ৪ জুন মৃত্যু হয় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের (চমেক) ইমার্জেন্সি মেডিক্যাল অফিসার ডা. মাহিদুল হাসান, ৮ জুন মৃত্যুকে বরণ করেন মা ও শিশু হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবু বক্কর সিদ্দিক। এভাবে মৃত্যুর মিছিলে একে একে যোগ দিয়েছেন আরও অনেক চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মী।

সিভয়েস/এপি

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়