Cvoice24.com


ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ ভাঙছে কোভিড-১৯

প্রকাশিত: ০৬:৩৬, ২৪ অক্টোবর ২০২০
ডায়াবেটিসের নিয়ন্ত্রণ ভাঙছে কোভিড-১৯

ডায়াবেটিস মেলিটাস হল একটি সাধারণ স্বাস্থ্য সমস্যা। এ বহুমাত্রিক শারীরিক সমস্যা অনেক রোগের উপসর্গের সঙ্গে সম্পর্কিত। আর এ কারণে ডায়াবেটিসজনিত সমস্যায় যারা ভুগছেন তাদের জন্য করোনার সংক্রমণ ভয়াবহ। কেননা, কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হারায়। ফলে ইনসুলিনের মাত্রা নির্ধারণে বেগ পেতে হয়। এমনটাই তথ্য প্রকাশ করেছে আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রকাশনা সংস্থা এলসেভিয়ার।

এলসেভিয়ার প্রকাশিত ‘ডায়াবেটিস অ্যান্ড মেটাবলিক সিনড্রোম : ক্লিনিক্যাল রিসার্চ অ্যান্ড রিভিউস’ জার্নালে কোভিড-১৯ আক্রান্তদের প্রসঙ্গে এ তথ্য জানানো হয়।

এ গবেষণা প্রবন্ধের 'বায়োকেমিক্যাল প্যারামিটারস অব কোভিড-১৯ পেশেন্টস উইদ এন্ড উইদাউট ডায়াবেটিস (Biochemical parameters of COVID-19 patients with and without Diabetes) অংশে বলা হয়েছে, কোভিড আক্রান্তদের বিভিন্ন জৈব রাসায়নিক এবং হেম্যাটোলজিকাল (রক্তজনিত) পরামিতি যাচাই-বাছাই করা হয়েছে। চিকিৎসা চলাকালে দেখা গেছে, ডায়াবেটিস আক্রান্ত ব্যক্তিরা ডায়াবেটিস ছাড়াই উল্লেখযোগ্যভাবে বেশি হাইপারগ্লাইসেমিক (পি <০.০৫) ছিলো। এছাড়াও সিরাম ক্রিয়েটিনিন (১৫.৯% বনাম ৪.৫%), সিআরপি (৪৪% বনাম ১৯%), ট্রোপনিন (৪৩.২% বনাম ১৫%) এবং ডাব্লুবিসি, ইএসআর-এর মোট গণনা উল্লেখযোগ্যভাবে (পি <০.০৫) ডায়াবেটিসবিহীন রোগীদের তুলনায় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত কোভিড-১৯ রোগীদের মধ্যে বেশি ছিল।

অর্থাৎ ডায়াবেটিকজনিত সমস্যায় যারা ভুগছেন, তারা কোভিডে আক্রান্ত হওয়ায় একইসঙ্গে একজন রোগীর অনেক অঙ্গকে আক্রান্ত করার প্রবণতা সৃষ্টি করে। আবার কোভিড-১৯ আক্রান্ত হওয়ার কারণে সুস্থতার পরেও তার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ হারায়। যেমন তার রক্তে গ্লুকোজ ও শর্করার পরিমাণ আকস্মিকভাবে উঠা-নামা করতে থাকে। ফলে তা অন্য যেকোনো দীর্ঘমেয়াদি রোগের ঝুঁকি সৃষ্টি করে এবং তা বাড়িয়ে দেয়।

গবেষণার তথ্যে বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে প্রতি এক শতাংশ কোভিড রোগীর মাঝে সুস্থ হয়ে ওঠার পর নতুন করে ডায়াবেটিস শনাক্ত হয়েছে। এক্ষেত্রে এইচবিএ-ওয়ানসি (HBA-1c) টেস্টের মাধ্যমে তা নিশ্চিত করা হয়েছে। কোভিড-১৯-এ আক্রান্ত হওয়ার পরবর্তীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হওয়ার তথ্য অন্যান্য দেশেও পাওয়া গেছে। আগে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইটালি ও সিঙ্গাপুরে অনেকেই কোভিডে আক্রান্ত হওয়ার পর নতুন করে ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন বলে নিউ ইংল্যান্ড জার্নাল অব মেডিসিনে প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও ওই গবেষণায় দেখা গেছে, কোভিডে আক্রান্ত ৪০ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীকেই ইনসুলিনের মাত্রা তিনগুণ করতে হয়, রক্তে গ্লুকোজ বা শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য। করোনা আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীদের ৯০ ভাগেরই জ্বর, ৬০ ভাগের কফ ও কাশি এবং ৪৫ ভাগের শারীরিক ব্যথা হয়েছে। ৬০ ভাগের বেশি রোগীর ফেরিটিন ও ডি ডাইমারের পরিমাণ অধিক পাওয়া গেছে। 

ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের মধ্যে উপসর্গবিহীন হওয়ার সংখ্যা কম। মাত্র ৪ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর মধ্যে কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর কোনও উপসর্গ বা লক্ষণ পরিলক্ষিত হয়নি। কিন্তু ডায়াবেটিসবিহীন করোনা রোগীদের মধ্যে বেশি উপসর্গবিহীন হওয়ার মাত্রা দেখা গেছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ও বিআইটিআইডি’র যৌথ গবেষণায় এ প্রবন্ধ লেখা হয়। গবেষণাটির সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলো চট্টগ্রামের ডিজিজ বায়োলজি অ্যান্ড মলিকুলার এপিডেমিওলজি রিসার্চ গ্রুপ। গবেষণা কার্যক্রমে নেতৃত্ব দেন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের ডায়াবেটিস ও হরমোন রোগ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের শিক্ষক ড. আদনান মান্নান। গবেষণা তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্বে ছিলেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. এইচ. এম. হামিদুল্লাহ মেহেদী ও ডা. আবদুর রব মাসুম, বিআইটিআইডি-এর ল্যাবপ্রধান ও অণুজীব বিজ্ঞানী ডা. শাকিল আহমেদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. মাহবুব হাসান এবং তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহে নেতৃত্ব দেন গবেষণা শিক্ষার্থী আসমা সালাউদ্দিন ও সাখাওয়াত হোসেন মিয়াজি।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের করোনা ইউনিটের দায়িত্বপ্রাপ্ত চিকিৎসক ডা. আবদুর রব মাসুম বলেন, 'করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদী বিভিন্ন সমস্যায় ভুগছেন ডায়াবেটিস রোগীরা। ডায়াবেটিস নাই এমন রোগীদের মধ্যে তুলনামূলক কম লক্ষ্য করা যাচ্ছে। গবেষণা করার কারণে আমরা দেখেছি, ২৮ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পরও চলফেরা করতে সমস্যা হচ্ছে, ১০ শতাংশের বেশি নিজের যত্ন নিতে পারছেন না, প্রায় ৪৪ শতাংশ শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা অনুভব করছেন, ২৫ শতাংশ বিষণ্নতায় ভুগছেন, প্রায় ৩৭ শতাংশ ভালোভাবে ঘুমাতে পারছেন না বা তাদের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটছে এবং এর মধ্যে ১ দশমিক ৭ শতাংশ দুঃস্বপ্ন দেখছেন।

তিনি আরো বলেন, 'করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর ১৩ শতাংশ ডায়াবেটিস রোগীর চুল পড়ে যাওয়ার সমস্যাও দেখা যাচ্ছে। আবার ২৯ শতাংশ একাগ্রচিত্তে মনোযোগ দেয়ার শক্তি হারিয়েছেন এবং প্রায় ২৫ শতাংশের স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে।

গবেষণা দলের ক্লিনিক্যাল প্রধান ডা. ফারহানা আক্তার বলেন, ‘আমরা জানি, ডায়াবেটিস রোগীর যেকোনও সংক্রমণ হলে স্ট্রেস হরমোন বেড়ে যায়, যা রক্তে গ্লুকোজ বৃদ্ধি করে। একইভাবে কোভিড আক্রান্ত রোগীরও এই স্ট্রেস হরমোনের কারণে ডায়াবেটিস মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে যায়। তাছাড়া কোভিডের চিকিৎসায় কিছু ওষুধ ব্যবহার করা হয়, যার কারণে ডায়াবেটিস বেড়ে যেতে পারে। সংক্রমণের কারণে ইনসুলিনও ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। ফলে রোগীর ইনসুলিন গ্রহণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। এর পাশাপাশি কোভিড আক্রান্ত ডায়াবেটিস রোগীর আরও কিছু বিশেষ বৈশিষ্ট্য আমরা পেয়েছি— যা এই গবেষণার একটি বিশেষ দিক। আমরা কোভিড পরবর্তী নতুন ডায়াবেটিস রোগী পেয়েছি, যাদের ব্যাপারে আমাদের আরও দীর্ঘমেয়াদি গবেষণার পরিকল্পনা আছে।’

তিনি আরও বলেন, 'ডায়াবেটিস রোগীরা করোনা থেকে সুস্থ হওয়ার পর দীর্ঘমেয়াদী কিছু সমস্যায় ভুগছেন। যেমন শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে ব্যথা, দুর্বলতা, অল্পে হাঁপিয়ে ওঠা এবং শ্বাসতন্ত্রের সমস্যা।

প্রসঙ্গত, পৃথিবীতে প্রতি দশজনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। বাংলাদেশে প্রায় এক কোটি লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। অর্থাৎ ১৫ কোটি জনসংখ্যা হলে প্রতি ১৫ জনে একজন ডায়াবেটিস রোগী আছে আমাদের দেশে। পৃথিবীতে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ অষ্টম। এছাড়া চট্টগ্রামে প্রায় দশ লক্ষের অধিক লোক ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। কাজেই ডায়াবেটিসের তীব্রতার কারণে করোনাভাইরাসের সাথে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক, প্রতিক্রিয়া, সুস্থ হতে জটিলতা ও চিকিৎসাপদ্ধতি নিয়ে গবেষণা জরুরি বলে মনে করেছেন গবেষকদল।

সিভয়েস প্রতিবেদক

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়