তিন দিনের পথ ঘণ্টায় পার 

মিশু দে, রাঙামাটি

প্রকাশিত: ২০:১০, ১৮ মার্চ ২০২৪
তিন দিনের পথ ঘণ্টায় পার 

দুর্গম দুমদুমিয়ায় যেখানে আগে যেতে সময় লাগতো দুই থেকে তিন দিন, সীমান্ত সড়কের কারণে সেখানে এখন পৌঁছাতে সময় লাগছে মাত্র কয়েক ঘণ্টা। সীমান্ত সড়ক পার্বত্যজেলাগুলোর সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিতের পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ব্যবসা বাণিজ্য প্রসার, আত্মসামাজিক উন্নয়ন, স্থানীয়দের উৎপাদিত কৃষিজ পণ্য বাজারজাতকরণ ও পর্যটন শিল্পের নতুন দুয়ার খুলবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

পাবর্ত্য চট্টগ্রামের সীমান্তে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ২০১৯সালে রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান পার্বত্য জেলায় সীমান্ত সড়ক নিমার্ণের ১ম পর্যায় শীর্ষক প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। সীমান্ত সড়ক ও সংযোগ সড়কসহ প্রকল্পের মোট দৈর্ঘ্য ১ হাজার ৩৬ কিলোমিটার। যা কয়েকটি পর্যায়ে সম্পন্ন হবে। এর মধ্যে একনেক কর্তৃক ১ম পর্যায়ের প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়েছে যার দৈর্ঘ্য ৩১৭ কিলোমিটার। তারমধ্যে ২২০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে এবং এ বছরে ৪৭ কিলোমিটার নির্মাণ কাজ চলমান আছে যা ২০২৪ সালের মধ্যে সম্পন্ন হবে। অবশিষ্ট ৪০ কিলোমিটার কাজের বেস টাইপ-১ এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে এইচবিবি পর্যন্ত সম্পন্ন করে রাখা হবে যা আগামী অর্থ বছরে সম্পন্ন করা হবে। ১ম পর্যায়ের এই প্রকল্পে নির্মাণ ব্যয় ৩ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা। প্রকল্পটির বর্তমান ভৌত অগ্রগতি ৮২ ভাগ ও আর্থিক অগ্রগতি ৮৫ভাগ। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কোর অব ইঞ্জিনিয়ার্স এর ৩৪ ইঞ্জিনিয়ার কনষ্ট্রাকশন ব্রিগেডের অধীনস্থ ১৭,২০ এবং এডহক ২৬ইঞ্জিনিয়ার কনষ্ট্রাকশন ব্যাটালিয়ন।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ঠেগামুখ-লইতংপাড়া-থানচি-দুমদুমিয়া-রাজস্থলী পর্যন্ত ১৩০ কিলোমিটার, সাজেক-দোকানঘাট-ঠেগামুখ পর্যন্ত ৯৫ কিলোমিটার, সাজেক-শিলদা-বেতলিং পর্যন্ত ৫২ কিলোমিটার এবং উখিয়া-আশারতলী-ফুলতলী পর্যন্ত ৪০ কিলোমিটার সড়ক নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। ১০৩৬ কিলোমিটারের পুরো সড়কটি নির্মিত হলে খাগড়াছড়ির রামগড় থেকে বান্দরবানের ঘুমধুম সরাসরি যাওয়া যাবে। প্রথম পর্যায়ের প্রকল্পের অধীনে ৬টি সেতু, ৩৬টি বেইলি ব্রিজ ক্রয় ও প্রতিস্থাপন, ২২১টি আরসিসি বক্স কালভার্ট নির্মাণসহ পাহাড়ি পথে সড়কটি নির্মাণ করা হচ্ছে।

প্রকল্পটির বাস্তবায়নের উদ্দেশ্য হচ্ছে, পার্বত্য জেলাসমূহের সীমান্ত বরাবর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি করা, সীমান্তের দুইপাশের অবৈধ ব্যবসা বন্ধ করা, দক্ষিণ পূর্ব এশিয়াতে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার বৃদ্ধি করা, সীমান্ত এলাকায় উৎপাদিত কৃষিপণ্যের বাজারজাতকরণের ব্যবস্থা করার মাধ্যমে কৃষিজ উৎপাদন বৃদ্ধিতে উৎসাহিত করা, শিল্পকারখানা স্থাপন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দেশী বিদেশী পর্যটকদের জন্য পর্যটনের নতুর দুয়ার খুলা এবং সীমান্ত এলাকায় সরকারি নিয়ন্ত্রণ বৃদ্ধিতে যোগাযোগ ব্যবস্থার সৃষ্টি করা।

প্রকল্পটি ইতিপূর্বে কয়েকদফায় নির্মাণ কাজ পরিদর্শন করেছেন সেনা প্রধান, সড়ক, পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিবসহ প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা।

সম্প্রতি রাজস্থলী থেকে জুরাছড়ির দুমদুমিয়া ৫৬ কিলোমিটার সড়ক ঘুরে দেখা গেছে, সড়কটির নির্মাণ কাজ বেশিরভাগই শেষ। সড়কের দুইপাশে প্রাণ জুড়ানো সবুজ প্রকৃতির দেখা মিলবে। আর মাঝে মাঝে দেখা মিলবে ছোট ছোট দুই একটি গ্রাম। রাজস্থলী এই সড়ক দিয়ে বিলাইছড়ির ফারুয়া ইউনিয়ন হয়ে জুরাছড়ির দুর্গম দুমদুমিয়ায় যাওয়া যায় মাত্র দুই থেকে আড়াই ঘণ্টায়, সে সময় সড়কটির পুরো নির্মাণ কাজ শেষ হলে আরো কমে আসবে। আগে যেখানে নদীপথে ও পাহাড়ি পথে হেঁটে বিলাইছড়ির ফারুয়া ও জুরাছড়ির দুমদুমিয়ায় যেতে সময় লাগতো দুই থেকে তিনদিন। সড়ক যোগাযোগের সাথে যুক্ত হতে পেরে খুশি এই সড়কের উদয়াচল, শান্তিপাড়া, রোয়াপাড়া ছড়া, আমকাটাছাড়াসহ এই এলাকার মানুষ। যেখানে আগে তারা কৃষিজ পণ্য স্থানীয় চাহিদা মেটানোর জন্য উৎপাদন করতো এখন তারা সেসব কৃষিজ পণ্য বাজারজাতকরণের জন্য উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছে। এই সড়কটি কখনো এক থেকে দুই হাজার ফুট নিচে নেমেছে আবার কখনো এক থেকে দুই হাজার ফুট উপরেউঠেছে। এখানে সড়ক হবে স্থানীয়দের কাছে যা আগে ছিল স্বপ্নের মতো। সড়কটি কখনো সোজা গিয়েছে পাহাড়ের বুক চিরে আবার কখনো নিচে নেমেছে আবার কখনো উঁচু পাহাড় হওয়ায় পাহাড়টিকে কয়েকটি ভাগে বিভক্ত করে জেড আকারে নির্মিত হয়েছে সড়ক। সড়কের কারুকার্য ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য যেকোন পর্যটককে নিসন্দেহে আকর্ষণ করবে।

৭০ পরিবারের রোয়াপাড়ার বাসিন্দা নন্দলাল চাকমা বলেন, এই সড়কটি হওয়ার পর আমি দোকান খুলেছি। বেঁচাকেনা দিনদিন বাড়ছে। সড়কটি পুরো হয়েগেলে তা আরো বাড়বে বলে মনে করছেন তিনি।

দুমদুমিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা শান্তি চাকমা বলেন, আগে আমাদের এখান থেকে রোগী হাসপাতালে নিতে দুই থেকে তিনদিন সময় লাগতো। অনেক সময় রোগী পথে মারাও যেত। সড়ক হওয়ার কারণে এখন রোগী যেমন হাসপাতালে নিতে সুবিধা হচ্ছে তেমনি ফসলগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রয় করতে সুবিধা হচ্ছে। যার কারণে আগের চেয়ে উৎপাদন বাড়িয়ে দিয়েছি।

১ম পর্যায়ের প্রকল্পটির পরিচালক কর্ণেল ভূঁইয়া মো. গোলাম কিবরিয়া বলেন, সমতলের তুলনায় পাহাড়ে কাজ করা অনেক চ্যালেঞ্জের। এখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকাসহ দূর্গমতার কারণে শ্রমিকরা থাকতে চাই না। তেমনি নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। তারপরও গুণগত মান বজায় রেখে কাজ চলছে।

সড়ক, পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, সড়ক বিভাগে অধীনে এটি দেশের দীর্ঘতম সড়ক হতে চলেছে। সড়কটি নিরাপত্তাসহ স্থানীয় অর্থনীতি ও পর্যটন শিল্পে ভূমিকা রাখবে। সেনাবাহিনীর বাস্তবায়নাধীন এই সড়কটি মে মাসে কাজ শেষ হলে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন।
 

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়