ওসি স্যারের সঙ্গে বেয়াদবি করবি?— বলেই ‘জ্বালা’ মিটিয়েছে পাঁচলাইশের পুলিশ

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৩:২০, ১৬ জানুয়ারি ২০২৩
ওসি স্যারের সঙ্গে বেয়াদবি করবি?— বলেই ‘জ্বালা’ মিটিয়েছে পাঁচলাইশের পুলিশ

পাঁচলাইশ থানার একটি রুমে নিয়ে এক পুলিশ সদস্য লাঠি দিয়ে মুস্তাকিমের কোমরের নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পেটায়। ছয় দিনেও তার শরীরে রয়ে গেছে লাঠির আঘাতের সেই লাল চিহ্ন। 

দুই কিডনি নষ্টওয়ালা মায়ের ডায়ালাইসিসের খরচ বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভে নামায় প্রথমে টেনেহেঁচড়ে থানায় নেওয়া হয় মুস্তাকিম নামে এক যুবককে। এরপর সেখানে নিজেদের ওপর হামলার দায়ে মামলা দিয়ে জেলেও পুরে পুলিশ। জেলে পুরার আগে ইচ্ছেমত বেধড়ক পিটিয়ে ‘জ্বালা’ মিটিয়েছে তারা। পাঁচলাইশ থানার একটি রুমে নিয়ে এক পুলিশ সদস্য লাঠি দিয়ে মুস্তাকিমের কোমরের নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত পেটায়। ছয় দিনেও তার শরীরে রয়ে গেছে লাঠির আঘাতের সেই লাল চিহ্ন। 

যদিও পুলিশ তা অস্বীকার করে উল্টো বলছে— যে অভিযোগ মুস্তাকিম করছে; তা বানোয়াট, মিথ্যা। তিনিই থানা থেকে কোর্টে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলেন, তাকে কোন নির্যাতন করা হয়নি। এখন কেন এসব মিথ্যা রটানো হচ্ছে সেই প্রশ্নও তুলেছে পুলিশ। 

হেফাজতে নিয়ে এমন অমানবিক আচরণের প্রতিকার চেয়ে ইতোমধ্যে জড়িত পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বরাবর সোমবার আবেদন করেছে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশন। সংগঠনটি মুস্তাকিমকে আইনি সহায়তা দিয়ে জেল থেকে মুক্ত করে।  

জানা যায়, ৫৫ বছর বসয়ী মুস্তাকিমের মা নাসরিন আক্তারের দুটি কিডনিই বিকল। সপ্তাহে তিনবার ডায়ালাইসিস করাতে হয়। সাত বছর ধরে এভাবে বেঁচে থাকার লড়াই করছেন বিধবা এই নারী। একমাত্র অবলম্বন মাদ্রাসাপড়ুয়া ২২ বছর বয়সী ছেলে মোহাম্মদ মুস্তাকিম। তার টিউশনির টাকাতেই চলতো নাসরিন আক্তারের ডায়ালাইসিসের খরচ। কিডনি রোগীদের ডায়ালাইসিস ফি কমানোর দাবিতে গত মঙ্গলবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনের সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করে রোগীর স্বজনেরা। একপর্যায়ে পুলিশের সঙ্গে ধস্তাধস্তি হয় বিক্ষোভকারীদের। এ সময় মুস্তাকিমকে আটক করে টেনেহেঁচড়ে পাঁচলাইশ থানায় নিয়ে যায়। এমনকি সেই সময় পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দিন মজুমদারকে এক নারীকে ল্যাং মেরে ফেলে দিতেও দেখা যায় এক ভিডিওতে। 

কারামুক্ত মুস্তাকিমের দাবি— মঙ্গলবার দুপুরে মুস্তাকিমকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যাওয়ার পর ওই দিন রাত আটটার দিকে হাজতখানা থেকে তাকে পার্শ্ববর্তী একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। এসময় নেমপ্লেটহীন এক পুলিশ সদস্য লাঠি দিয়ে ‘ওসি স্যারের সঙ্গে আর বেয়াদবি করবি?’— বলে বলে ১৫ থেকে ২০ মিনিট ধরে বেধড়ক পেটাতে থাকে। এতে মুস্তাকিমের কোমরের নিচ থেকে পায়ের গোড়ালি পর্যন্ত লাল হয়ে যায়। ছয় দিনেও তার শরীরে রয়ে গেছে লাঠির আঘাতের সেই লাল চিহ্ন। 

মুস্তাকিমকে আইনি সহায়তা দিয়ে আসা হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের মহাসচিব জিয়া হাবিব আহসান সিভয়েসকে বলেন, ‘মুস্তাকিম কারামুক্ত হওয়ার পর তাকে থানা হাজতে যে নির্যাতন করা হয়েছে; সে বিষয়ে আমাদের জানিয়েছে। এর প্রতিকার চেয়ে আমরা আইজিপি বরাবরে লিখিত আবেদন করেছি। ব্যবস্থা না নিলে হেফাজত নির্যাতন নিবারণ আইনে মামলা করব।’ 

অভিযোগের বিষয়ে জানতে পাঁচলাইশ থানার ওসি নাজিম উদ্দীন মজুমদারকে ফোন করে পাওয়া যায়নি। পরে সিএমপির উপ কমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সিভয়েসকে বলেন, ‘তাকে (মুস্তাকিম) থানা হাজতে কোন ধরণের নির্যাতন করা হয়নি। থানা থেকে কোর্টে যাওয়ার পথে সাংবাদিকদের সামনে বলেছিলো, তাকে কোন নির্যাতন করা হয়নি। এখন কেন এসব মিথ্যা রটানো হচ্ছে?’ 

এসময় একটি ইউটিউব চ্যানেলে মুস্তাকিমের দেওয়া সাক্ষাৎকারের ভিডিও ক্লিপও সিভয়েসের কাছে পাঠান সিএমপির উত্তর বিভাগের এ অভিভাবক।     

গত ১০ জানুয়ারি চমেক হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিসের ফি কমানোর দাবিতে সড়ক অবরোধকে কেন্দ্র করে পুলিশের সঙ্গে রোগী ও তাদের স্বজনদের  হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। এতে মুস্তাকিমকে (৩০) গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ঘটনার দিন রাতেই পাঁচলাইশ থানার এসআই মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে মুস্তাকিমের নাম উল্লেখ করে মামলা করে। এছাড়া অজ্ঞাত আরও ৫০ থেকে ৬০ জনকে মামলার আসামি করা হয়। 

সেসময় পাঁচলাইশ থানার ওসি (তদন্ত) সাদেকুর রহমান বলেছিলেন, ‘চমেক হাসপাতালে কিডনি ডায়ালাইসিসের ফি কমানোর দাবিতে সড়ক অবরোধ করে রোগী ও তাদের স্বজনরা। এসময় সড়কের উপর থেকে সরে গিয়ে আন্দোলন করার অনুরোধ জানালে তারা পুলিশের উপর চড়াও হন। একপর্যায়ে তারা কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বাকবিতণ্ডা ও হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। তাই পুলিশের উপর হামলা ও কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে এ মামলা দায়ের করা হয়।’

প্রসঙ্গত, পিপিপি’র (পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ) আওতায় ভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্যান্ডর মেডিকেইডস (প্রা.) লিমিটেড ডায়ালাইসিস সেবা দিয়ে আসছে চমেক হাসপাতালে। আগে সরকারিভাবে প্রতি সেশনে ৫১০ টাকা ও বেসরকারিভাবে ২ হাজার ৭৯৫ টাকা করে ডায়ালাইসিস করা হতো। কিন্তু প্রতি বছর চুক্তি অনুযায়ী ৫ শতাংশ বেড়ে গিয়ে ডায়ালাইসিস ফি দাঁড়িয়েছে সরকারিভাবে ৫৩৫ টাকা ও বেসরকারিভাবে ২ হাজার ৯৩৫ টাকা। এ কারণেই রোগীরা ফি বৃদ্ধির দাবিতে আন্দোলনে নামে।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়