অনিয়ম/ পিসি রোডের সংস্কার শেষ না হতেই বেরিয়ে আসছে নানা ক্ষত

সিভয়েস প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২০:২০, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২২
অনিয়ম/ পিসি রোডের সংস্কার শেষ না হতেই বেরিয়ে আসছে নানা ক্ষত

সড়কে পিচ ঢালাইয়ে ব্যবহার হচ্ছে নিন্মমানের ইট-পাথর, বিটুমিনসহ বিভিন্ন সামগ্রী। পাশাপাশি পিচ ঢালাইয়ে যে পুরুত্ব দেয়ার কথা তার ছিটেফাঁটাও নেই।

দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের অর্থনীতির ‘লাইফ লাইন’ খ্যাত পোর্ট কানেক্টিং (পিসি) সড়কটি দেড় বছরে শেষ করার কথা থাকলেও পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। তবে কাজ শেষ না করে বিল নিয়ে ঠিকাদার উধাও, কখনও মেয়রের হাতে নিন্মমানের টাইলস ভাঙচুরসহ নানা বিতর্কিত কাণ্ডে পুরো ৫ বছর ধরে এ উন্নয়ন প্রকল্পটি ছিল সামলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কাজ যখন প্রায় শেষের দিকে তখন অভিযোগ উঠেছে— সড়কে পিচ ঢালাইয়ে ব্যবহার হচ্ছে নিন্মমানের ইট-পাথর, বিটুমিনসহ বিভিন্ন সামগ্রী। পাশাপাশি পিচ ঢালাইয়ে যে পুরুত্ব দেয়ার কথা তার ছিটেফাঁটাও নেই। ফুটপাতের টাইলসের মতো উঠে আসছে সড়কের ডিভাইডারে বসানো গ্রিলও আর ড্রেনের সারফেস ব্লক!

অথচ এর আগে গত ৬ জানুয়ারি পিসি রোডের নিমতলায় সড়ক সংস্কার কাজ পরিদর্শনে গিয়ে ফুটপাতে নিন্মমানের টাইলস দেখে চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী। এ সময় নিজ হাতেই বেশ কয়েকটি টাইলস উঠিয়ে ফেলেন তিনি। পাশাপাশি শোকজ করা হয় চসিকের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মিনহাজ উদ্দিন ও সুপারভাইজার মো. আরিফকে। যদিও সেই আদেশ সেখানেই সীমাবদ্ধ ছিল। 

এদিকে স্থানীয়রা বলছেন, এ সড়কের কাজ চলাকালেই বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে নানা ক্ষত। সড়কের পূর্ব নিমতলাসহ বিভিন্ন অংশে কার্পেটিং কাজ শেষ না হতেই উঠে আসতে শুরু করেছে সড়কের ইট-সুড়কি। এর পাশাপাশি ভারী গাড়ী চলাচলে ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে সড়কের বেশ কিছু অংশে। পিচ ঢালাইয়ে পাতলা আস্তরণের ফলে পুরো সড়কের বিভিন্ন অংশে ফাটলও দেখা দিচ্ছে। এমন অবস্থায় কাজ শেষের অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের ‘লাইফ লাইন’ নামের সড়কটি মুখ থুবড়ে পড়বে।

এদিকে সরেজমিনে দেখা যায়, পিসি রোডের হালিশহর, নিমতলা, বড়পোলসহ বিভিন্ন অংশের ফুটপাতের বেশির ভাগ অংশেই উঠে আসছে টাইলস। যে টুকু অংশে টাইলস আছে, সেখানেও দেখা গেছে ফাটল। ফুটপাতের যে পাশে ‘সারফেস ব্লক’ আছে সেগুলোও খুলে পড়ে গেছে। অবশ্য সেখানে ফুটপাতের যতটুকু অংশে টাইলস বসানো হয়নি সেখানে চুক্তি মোতাবেক বিল্ডকম টাইলস বসানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। অন্যদিকে গত ৩ ফেব্রুয়রি দুপুরের দিকে পিসি রোড সংগ্ন পোর্ট কলোনি মসজিদ এলাকায় দেখা গেছে, সড়কের ডিভাইডারে হেলে পড়ছে বেশ কয়েকটি গ্রিল। হেলে যাওয়া সেই গ্রিলেই রংয়ের কাজ করছেন কয়েকজন শ্রমিক। হেলে পড়া গ্রিল মেরামত না করে কেন রং করা হচ্ছে- এ প্রশ্নে উত্তরে মনজু নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘পার্টি (কর্তৃপক্ষ) বলসে রং করে দিতে, তাই করতাসি। আপনাদের কথা থাকলে তাদের সাথে বলেন।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক চসিকের প্রকৌশল বিভাগের একজন সিভয়েসকে বলেন, ‘কথা ছিল সড়কে ৬০ এমএম ওয়ারিং কোর্স হবে। অর্থাৎ রোলিংয়ের পর কার্পেটিং দুই ইঞ্চি মতো টিকবে। কিন্তু কোথাও ৩০ এমএম, কোথাও ৪০ বা ৪৫ এম এম দেওয়া হচ্ছে। ভালো মত খেয়াল করলে বুঝবেন, পাতলা পিচ ঢালাইয়ের ফলে সড়কের বিভিন্ন অংশে ঢেউ ঢেউ হয়ে আছে। একেক অংশে একেক নিয়মে রকম কার্পেটিং করা হয়েছে। যেমন পোর্ট কলোনির সামনে রাস্তার পশ্চিম পাশে মাত্র ৩০ এমএম দিয়ে কাজ সেরে ফেলা হয়েছে।’

শোকজ যারা দায়িত্বে তারাই!

দায়িত্বে অবহেলার দায়ে সবশেষ গত ৬ জানুয়ারি নিমতলা রোডের ফুটপাতে নিন্মমানের ফুটপাত দেখে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন মেয়র রেজাউল। সে সময় এ সময় মেয়র নিজেই ফুটপাতে লাগানো কয়েকটি ভাঙা টাইলস তুলে ছুড়ে ফেলেন। আকস্মিক পরিদর্শনের সময় দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রকৌশলী ও সুপারভাইজারকে না পেয়ে তাদের কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরে শোকজ করা হয়— চসিকের উপ সহকারী প্রকৌশলী মিনহাজ উদ্দিন ও সুপারভাইজার মো. আরিফকে। শোকজের ‘সন্তোষজনক’ জবাব দিয়ে তারা  ফের পিসি রোড দেখভালের দায়িত্ব পালন করছেন।

অথচ প্রায় ৪ কিলোমিটার ফুটপাতে নিন্মমানের বা চুক্তি বর্হিভূত টাইলস বসানোর বিষয়টি কিভাবে একবারেই চসিকের নজর এড়িয়ে গেছে— সেই প্রশ্নের উত্তরে বরাবরাই ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী আনোয়ার জাহান। 

চসিকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের একজন সিভয়েসকে বলেন, ‘শোকজের পর সচিবালয় বিভাগে ফাইল পাঠানো হয়নি। এমনকি অভিযুক্তরা কি জবাব দিয়েছে সেটাও জানানো হয়নি।’

দুর্নাম লেগেই আছে সংস্কার কাজে

২০১৭ সালে সড়কটির সংস্কার কাজ উদ্ধোধন করেন তৎকালীন চসিক মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিন। তখন চসিকের পক্ষ থেকে ঢালাওভাবে শোনানো হচ্ছিল উন্নয়নের ফুলঝুড়ির কথা। তবে দেড় বছরেই নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ৫ বছরে তা হয়নি। বরং সংস্কার কাজে নানা গাফেলতি ও অনিয়মে ভোগান্তি বেড়েছে ওই এলাকার বাসিন্দাদের। জাপানের দাতা সংস্থা জাইকার অর্থায়নে এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ‘সিটি গভর্নেন্স প্রকল্পের’ আওতায় প্রকল্পে ব্যয় হচ্ছে ১৬৮ কোটি টাকা। পৃথক পৃথক লটে ৫ দশমিক ৬৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পোর্ট কানেক্টিং সড়কটির উন্নয়নকাজ চলছে। যা বাস্তবায়ন করছে চসিক। তবে সেই ২০১৭ সাল থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দুই জন মেয়র ও একজন প্রশাসক চসিকের দায়িত্বে ছিলেন। তারা সবাই সড়কের কাজ ধীর গতি ও নানা অনিয়ম, অসঙ্গতি নিয়ে উষ্মা ও চরম অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। অসন্তোষের ধারাবাহিকতায় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কালোতালিকা ভুক্তও করা হয়েছে। তবে অনিয়ম থামেনি সড়ক নির্মাণ কাজে।

চসিকের লুকোচুরি

দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়টি চসিকের নজরে আছে কি’না তা জানতে চেয়ে যোগাযোগ করা হলে ব্যস্ততার অজুহাতে কল কেটে দেন চসিকের প্রধান প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম। চসিক সচিব খালেদ মাহমুদের সাথে যোগাযোগ করা হলে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগের কথা বলে ফোন কেটে দেন তিনিও। বক্তব্য জানতে চেয়ে একাধিক কল করেও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শহীদুল আলমের সাড়া পাওয়া যায়নি। 

পরে পিসি রোডে অনিয়মের তথ্য নিয়ে ওমরা পালনে সৌদি আরব যাওয়ার আগে মেয়র রেজাউলের সাথে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করে সফল হওয়া যায়নি। অথচ গত ৬ জানুয়ারি নির্মাণ কাজের ত্রুটির বিষয়ে অভিযোগ জানানোর জন্য স্থানীয়দের কাছে ব্যক্তিগত সহকারীর মোবাইল নম্বার সরবরাহ করেন মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। যদিও কোন নাগরিক সেই অনিয়মের খবর মেয়র রেজাউলে কাছে সফলভাবে পৌঁছাতে পেরেছেন এমন নজির নেই।

সর্বশেষ

পাঠকপ্রিয়